শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ধারাবাহিক থ্রিলার  

সাইকোপ্যাথ (পর্ব ৮)

আপডেট : ২৩ জুন ২০২০, ১০:০৮

এবার একটু বলো তো পিটার ভায়া, টনির পরিবারে আর কে কে আছে?

পিচিক করে থুতু ফেলল পিটার। যা কিনা সভ্যসমাজে একেবারে অচল। বলল, ওর কথা আর বলবেন না, টনি একটা বদলোক। এই জগতে এখন আর কেউ নেই ওর।

তার মানে! আগে কেউ ছিল?

ছিল তো। লুসি কাবেরি! ওর গার্ল ফ্রেন্ড। পিটার বলল।

উর্বী কী যেন ভাবছে। নাম শুনে কেমন ইন্ডিয়ান মনে হয়। উর্বী বলল, ইজ শি ইন্ডিয়ান? 

ইয়েস, ম্যাডাম। লুসি ইজ অ্যা গুড গার্ল। পিটার মাথা নাড়ল।

লুসি তাহলে টনিকে ছাড়লো কেন?

নো, নো ম্যাম, লুসি তাকে ছাড়েনি। টনি ডিচ্ড হার। লুসি নির্দোষ। অমনি রায় দিয়ে দেয় পিটার। অর্থাৎ টনির সঙ্গে পিটারের খুব একটা সুসম্বন্ধ নেই।

পিটার আরো জানাল যে, বছরখানেক যাবৎ টনি একাই আছে। ওই তার বাড়ি। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। টনি নাক কেটে হাসপাতালে পড়ে আছে। মন্দ লোক, তাই সাজা খাটছে। নিচু গলায় টনি বলল।

তাই বলে নাক কাটবে! আর কিছু কাটতে পারলো না? ক্ষোভের সুরে বলল উর্বী।

জবাবে পিটার কী বলল জানেন! বদমাশ বলে কিনা, ওর নাকের ওপর দিয়ে গেছে তা-ই ভালো। ওর যা শত্রুপক্ষ, তাতে ওর নুনু কাটা যায়নি, সেই ঢের।  

অলোকেশ আর সেখানে দাঁড়ানোর সাহস করেননি। পিটার এরপর কী বলবে কে জানে! তিনি বুঝলেন, ওরা যেমন একে অপরের প্রতিবেশী, দুটোই তেমনি বাজে লোক। টনির পূর্ব ইতিহাস খুব একটা ফর্সা নয়। কী জানি, পুরনো পাপের কারণেই হয়তো তার নাক কাটা গেল! 

ফেরার আগে উর্বী বুদ্ধি করে টনির গার্লফ্রেন্ড সেই লুসি কাবেরির নম্বরটা নিয়ে নিল। সহজে কি আর দিতে চায়! মেলা শংসাবচন শুনিয়ে তারপর পিটারকে পথে আনা গেল।

পরদিন সকালে রিনি ওদের চেরি স্ট্রিটের বাসায় এল। সানডে তাই ওর ডে অফ। ওরা বলে সুইট সানডে। অলোকেরও তেমন কিছু করার নেই। সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি। অবশ্য এখানে প্রফেসরদের কোনো ছুটি থাকে না। তারা ফুলটাইম টিউটর। নো পলিটিক্স, নো ছুটিছাটা।

কথাপ্রসঙ্গে প্রফেসর কিম সেদিন বলছিলেন যে, ভিক্টোরিয়া স্টেটের গভর্নর কে, তা নিয়ে তিনি ভাবেন না। শুনেছেন লিন্ডা ডেসু নামে এক মহিলা নাকি দায়িত্ব পেয়েছেন। স্টেটের প্রিমিয়ার বা প্রধানমন্ত্রী এখন ড্যানিয়েল এন্ড্রু, এটা তিনি জানেন। কারণ গেল মাসে এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে এসেছিলেন। তবে চিফ গেস্ট নন, স্রেফ বক্তা। 

কিমের যুক্তি হলো, তিনি প্রিমিয়ার তাতে কী এসে যায়! প্রফেসরস আর ফার মোর নিডেড দ্যান দ্য প্রিমিয়ার। বোঝো ঠেলা!

কথা শুনে উর্বী মুচকি মুচকি হাসে। সে কী কথা! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাবেন আর সিটিং পার্টির সঙ্গে খাতির রাখবেন না, তা-ই কি হয়! আর আমাদের দেশে কী হয়! তেলবাজ ভিসি তার নিজের বাপের নাম ভুলে যান তবু দলীয় নেতার নাম ভোলেন না।

রিনি খালি হাতে আসেনি। সে বাঙালি কেতা কী তা জানে এবং বোঝে। রিনির হাতে বাস্কেটভর্তি ফলমূল, আইসক্রিম, ইওগার্ট আর সবজি।

আরে, এত সবজি তুমি কোথায় পেলে রিনি? পুঁইশাক দেখছি! বিস্মিত উর্বী। কারণ সে জানে, মেলবোর্নে সবচে দামি হলো গিয়ে শাকসবজি। কাঁচামরিচ কেউ খায় না, কারণ একশ গ্রাম মরিচের দামে পাঁচ কিলো ক্যাঙ্গারুর মাংস পাওয়া যায়। কাঁচা পেঁপে মেলা ভার। শুধু অসুখ করলে পথ্য হিসেবে কেউ কেউ হয়তো খায়। আরেকটি দুর্মূল্য বস্তু হলো কাকরোল। এসব সবজি এদেশে হয় না, ইমপোর্ট করাও দুষ্কর, কারণ আনতে আনতে কাকরোলের কাঁটা থাকে না, ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।

রিনি আরেকটা তথ্য দিল। বলল, শুধু কি তা-ই, অস্ট্রেলিয়ান সরকার রোগ-জীবাণুর ব্যাপারে খুব সতর্ক। বলতে পারো শুচিবায়ু আছে। এরা এক স্টেটের ফলমূল বা ফুলটুল অন্য স্টেটে নিতে দেয় না, পাছে ফল-ফুলের সাথে সাথে জীবাণুও পাচার হয়ে যায়!

তা-ই বলো। এজন্যেই তো এখানে রোগবালাই কম। হাঁচি-কাশি বা হাঁপানির টান নেই কারো। ডাক্তাররা বসে বসে মশামাছি মারে।

শোনো রিনি, আজ রাতে কিন্তু তুমি এখানেই খেয়ে যাবে। খুশিতে ডগমগ হয়ে উর্বী বলল। ভিনদেশে এসে সে এমন একজনকে পেয়েছে, যার সঙ্গে দিল খুলে একটু কথা বলা যায়।

আরে না না, কাজ আছে। আমাকে বেরোতে হবে। জানোই তো, রিপোর্টার মানে ‘অল টাইম অন-ডিউটি’। কখন কী হয়, তাই সবসময় তৈরি থাকতে হয়। রিনি বলল। 

উঁহু। আজ আমি তোমার কোনো কথা শুনছি না রিনি সেন। তুমি আমাদের সঙ্গে ডিনার করবে, ব্যস। অলোকেশও উর্বীর কথায় সায় দিলেন। ‘এসেই যখন পড়েছো, খেয়ে যাও। সেই সঙ্গে নাককাটার ব্যাপারে কিছু আলাপও করা যাবে। তার আগে কফি খাবে তো?’

‘আই ডোন্ট মাইন্ড হ্যাভিং সাম কফি উইদ ইউ।’ হেসে বলল দ্য এজ পত্রিকার অপরাধবিষয়ক রিপোর্টার রিনি সেন। 

লাত্তে, নাকি মোক্কা?

নো নো, এসব কিছু না। তুমি জাস্ট নরমাল ব্লেন্ড বানাও। তবে কফি বিন্স একটু কড়া রোস্টেড হলে ভালো, তাতে ফ্লেভার ভালো হয়, আবার ক্লান্তিও কেটে যায়। এমনভাবে রিনি বলল, যেন সে বিশিষ্ট কফি-স্পেশালিস্ট।

ওকে রিনি, তা-ই হবে। অলোকেশ কিচেনে গেলেন। এসকল দেশে হেঁসেল মানেই নারীর আধিপত্য, তা কিন্তু নয়। এখানে রসুইঘর অলওয়েজ ইউনিসেক্স, অর্থাৎ নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান প্রবেশাধিকার।

তারপর বলো উর্বী, আপডেট কী! নতুন কোনো খবর পেলে?

পেয়েছি তো। নাককাটার বাড়ি গেছিলাম আমরা। ওর নাম আসলে টনি, ফ্রম হংকং। সে পেশাদার জেলে। ওর কাঁচা মাছের কারবার। টনির এক প্রতিবেশী পিটার, সে বলল, টনি নাকি লোক খুব একটা সুবিধার নয়। বদমেজাজি, স্বার্থপর তাই ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড টেকে না। তবে সে খুব সহজে বন্ধু বানাতে পারে।

তা-ই নাকি!

ইয়েস রিনি। মাথা নাড়ে উর্বী। ওর একজন প্রাক্তনের খবর আমরা পেয়েছি। তার সেল নম্বরও নিয়ে এসেছি। মেয়েটার নাম লুসি কাবেরি। সম্ভবত ইন্ডিয়ান। টনির সঙ্গে লিভ-টুগেদার করতো, কিন্তু এখন আর সে নেই। টনির সাথে টিকতে পারেনি লুসি। 

অমনি গম্ভীর হয়ে যায় রিনি সেন। তারপর বলল, বুঝলে উর্বী, আমাদের এশিয়ানদের এই এক প্রবলেম। এরা না বুঝেশুনেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পানি যখন অনেকখানি গড়ায়, তখন ঠিক বুঝতে পারে, তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে যায়। ফেরবার আর উপায় থাকে না বা ফিরলেও মনের ভিতরে গভীর ক্ষত তৈরি হয়। সেই ক্ষত শুকোতে শুকোতে বাকি জীবন বরবাদ।

রিনির কণ্ঠে উর্বী কেমন যেন বিয়োগান্তক সুর শুনতে পায়। তবে কি রিনির জীবনেও কোনো ট্র্যাজেডি এসেছিল! খুব পারসোনাল অ্যান্ড ডেলিকেট ম্যাটার। তাই ঔৎসুক্য চেপে গিয়ে উর্বী বলল, এই নাও লুসির নম্বর। তুমি একবার ট্রাই করে দেখতে পারো। টনির ব্যাপারে আমরা হয়তো নতুন তথ্য পাবো।

হুঁ। অন্যমনস্কভাবে বলল রিনি সেন। ততক্ষণে কফি এসে গেছে। অলোকের দু হাতে তিন মগ কফি।  

বাহ্! ফ্লেভারটা দারুণ! রিনি ও উর্বী সমস্বরে বলল।

(চলবে)


লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]