বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্মরণ

গানের সখা, প্রাণের সখা নীলোৎপল সাধ্য

আপডেট : ২৭ জুন ২০২০, ০০:৫৯

সারাদিন মেঘলা আকাশ
সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি
বৃষ্টি ভেজা বাতাসে
স্বরবিতানের স্বরলিপি
আর গীতবিতানের পাতারা
উড়ে যায়, ঝরে পড়ে
যেন শান্তির ধারা।
অঝরা বৃষ্টির ধারার মাঝে
দূর পাহাড়ের ঝর্ণার কলতান লুকিয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার সজল গানে
নীলোৎপল সাধ্যর গীত গান মনে আনে।
রবির আলোয় আলোকিত নীলোৎপল সাধ্য
রবিরশ্মি ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর আরাধ্য।
আজ শতদিন তুমি নীলিমায় লীন
তোমার কাছে আছে মোদের
গানের সুরের ঋণ।
 
আমাদের গানের সখা, প্রাণের সখা নীলোৎপল সাধ্য যিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, অক্লান্ত পরিশ্রমী সংগঠক ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাগতিক বন্ধন ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন মাস কয়েক হলো। ব্যক্তি নীলোৎপল সাধ্য আমাদের মাঝে আর নেই কিন্তু তাঁর স্মৃতি তাঁর প্রিয় সংগঠন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, এই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর অগণিত রবীন্দ্রসংগীতের শিষ্যদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। বাংলাদেশে যতদিন জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ টিকে থাকবে ততদিন তাঁর নাম গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, শিক্ষক তথা সংগীত গুরু। ষাটের দশকে এদেশে রবীন্দ্রসংগীতচর্চা নিষিদ্ধ ছিল। এমন বিপ্রতীপ সময়ে এদেশের ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রচেতনাকে পৌঁছে দেবার দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন বাংলাদেশে শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা ও অনুশীলনের চিরব্রতী  আচার্য ওয়াহিদুল হক এবং তাঁর সমমনা কিছু মানুষ। ওয়াহিদুল হকের ভাবশিষ্য, জীবদ্দশায় ওয়াহিদুল হকের ছায়াসঙ্গী এবং তাঁর মৃত্যুর পর ওয়াহিদুল হকের কাজকে অব্যাহত রেখেছেন নীলোৎপল সাধ্য। গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে শুদ্ধভাবে রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়েছেন এবং রবীন্দ্র ভাবাদর্শে দীক্ষিত করার জন্য সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন।

নীলোৎপল সাধ্য ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ধোবাউড়ায় ১৯৫৫ সালে ৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধ্য গ্রামে তবলা বাজাতেন এবং ফুটবল খেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর কাকা সুনীল সাধ্যর কাছে গানে প্রথম হাতেখড়ি। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময়েই নীলোৎপল সাধ্য প্রথম একটি জারিগানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। সেই থেকে তাঁর গানের প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা তৈরি হয়। তাঁদের গ্রামে সংগীত জানা একজন মানুষের বাড়িতে রেডিওতে কলকাতার আকাশবাণীর সংগীত শিক্ষার আসর প্রতি রবিবার শোনা হতো, নীলোৎপল সাধ্য তাঁর সঙ্গে বসে অনুষ্ঠান শুনতেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মায়। তবে প্রথম যেদিন সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জনের সামনে বসে তিনি গান শেখার সুযোগ পান, সেদিন তাঁর নিজেকে সত্যি সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল, ‘সেদিন মনে হয়েছিল যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আমার সামনে বসা। মনে হলো যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি এটাই।’ তিনি সবসময় বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান আমার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। সমস্ত গ্লানি ও মলিনতা থেকে দূরে রাখে।’

পেশাগত জীবনে নীলোৎপল সাধ্য বাংলাদেশ টিএনটি বোর্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন ২০১৬ সালে। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি সংগীতের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৮১ সালে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ময়মনসিংহ শাখার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২৬ বছরের নীলোৎপল সাধ্যর সাংস্কৃতিক জীবনের সূচনা। তারপর আর থেমে থাকেননি।

রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাদানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব আবেগপ্রবণ। সংগীতের শিক্ষাদানে ব্যতিক্রমী পদ্ধতিটি তিনি শিখেছিলেন তাঁর গুরু ওয়াহিদুল হকের কাছ থেকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওয়াহিদুল হক প্রথমেই বাণীকে আবৃত্তি করতেন, ছন্দে বলতেন, ত্রুটিহীন উচ্চারণ যেন হয় তার জন্য বর্ণের মূলে চলে যেতেন, শব্দের মানে বলতেন, গানের প্রেক্ষাপট বলতেন। তারপর তাল ও রাগের বর্ণনা করতেন। রাগের বিশ্লেষণ ছিল অনন্য সাধারণ। যে রাগের স্বরটি শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয় না সেই রাগের দ্বারা সৃষ্ট গানের অব্যবহৃত সেই স্বরের ব্যবহার করতে গিয়ে গানখানি কেমন হয়ে উঠল, কাজ কীভাবে সেই স্বরে বিহার করে গানখানি কতটুকু রসময় হলো, এমন রূপময় বর্ণনা দিতেন। তারপর গানখানি সঠিক সুরে, সঠিক ছন্দে, সঠিকভাবে গীত হলো কি না তার বিশদ মূল্যায়ন। একটি রবীন্দ্রসংগীত গীত হতে গেলে কী কী প্রয়োজন, সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা করতেন। রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার পর সকলেই তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করত গান কেমন হলো? রবীন্দ্রসংগীত সুন্দরভাবে গীত হলে যেমন প্রশংসা করতেন তেমনি অবলীলায় ত্রুটিগুলোও বলে যেতেন। তবে গান শুনিয়ে তাকে খুশি করা খুব দুরূহ কাজ ছিল।’

ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুর পর নীলোৎপল সাধ্যর জীবনের সাধনা ছিল তরুণপ্রজন্মকে শুদ্ধভাবে রবীন্দ্রসংগীত শেখানো এবং রবীন্দ্রচেতনায় উদ্বুদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতির রুচিবান বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেবার সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। নীলোৎপল সাধ্য প্রথম কুমিল্লায় আসেন ১৯৮৮-৮৯ সালে। এরপর তিনি বহুবার কুমিল্লায় এসেছেন রবীন্দ্রসংগীত প্রশিক্ষক, বিচারক এবং কেন্দ্র থেকে আগত শিল্পী হিসেবেও। তিনি যখনেই এসেছেন আমরা সবাই ঋদ্ধ হতাম তাঁর প্রশিক্ষণে। তিনি কুমিল্লা এলে সাধারণত মিতা দি’র (মিতা পাল) বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতেন। মিতা পাল জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ কুমিল্লা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সংগঠনের প্রাণ, সংগীত গুরু এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ওয়াহিদুল হকও কুমিল্লা এলে মিতা পালের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতেন। তাঁরা এলেই দিদির বাসায় প্রশিক্ষনের পাশাপাশি সংগীতের আসর বসতো। নীলোৎপল সাধ্য আমাদের কাছে ‘নীলোৎপল দা’ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ‘নীলোৎপল কাকু’। আমার দুই কন্যাও তার কাছে গান শিখেছেন। নীলোৎপল সাধ্য দীঘল দেহী, সুন্দরকান্তি রুচিবান, মৃদুভাষী, সদালাপী, বিনয়ী এবং সংগীত ও সংস্কৃতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন, তাঁর ছিল প্রমিত বাংলা উচ্চারণ। ছাত্র-ছাত্রীদের ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাংলা শব্দের উচ্চারণ এবং সঠিকভাবে স্বরবিতান অনুসরণে অত্যন্ত শুদ্ধভাবে গান শেখাতেন। গানের বাণী, সুর ও গানের অর্ন্তনিহিত ভাব সবকিছুই সঠিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ঙ্গম করানোর প্রয়াস পেতেন।

নীলোৎপল সাধ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সাল থেকে সংগীত বিভাগে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক হিসেবে খণ্ডকালীন অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও সংগীত বিভাগে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। একবার কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁর সংগীত পরিবেশনার পর কলাকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় সে গানের প্রশংসা করে সংবাদ ছাপা হওয়ার মতো ঘটনার পাশাপাশি সারাজীবন সমাজের নানা স্তরের মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করেছেন তিনি।

তিনি সারাদেশে চল্লিশ বছরে কমপক্ষে সহস্রাধিক সংগীতকর্মশালা করেছেন এবং শেষের দিকে তিনি রজনীকান্তের অসংখ্য গান গেয়েছেন এবং কয়েকটি সিডিও প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বার্ষিকীতে ‘সুরের ধারা’ থেকে প্রকাশিত ‘শ্রুতি গীতবিতান’-এ তাঁর গাওয়া অনেক গান রয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। প্রায় তিন বছর তিনি বাংলাদেশ এবং ভারতে চিকিৎসা নেন। ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে তিনি কুমিল্লায় এসে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ কুমিল্লা শাখার নবগঠিত কার্যকরী পরিষদ ও উপদেষ্টা মণ্ডলীর নাম ঘোষণা করেন। এরপরও তিনি ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রশিক্ষণ দেন এবং প্রশিক্ষণার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনা করেন এবং প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে সনদ তুলে দেন। 

করোনাকালে এই বিপন্ন সময়ে খানিকটা নিঃশব্দেই চলে যেতে হলো তাঁকে। অথচ এমন অনাড়ম্বর বিদায় তাঁর কাম্য ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহটি শহীদ মিনারে তো নয়ই,  তাঁর আজীবন ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান ছায়ানটেও একবারের জন্য নেওয়া গেল না। তাঁর মৃত্যু তাঁর অকাল বিধবা পত্নী ঝর্ণা মল্লিক ও তাঁর কন্যা অঝরা সাধ্যর জন্য অতীব দুঃখের বিষয় এবং অত্যন্ত শোক ও পরিতাপের বিষয় তাঁর ছাত্র-ছাত্রী সহকর্মী, সতীর্থ শিল্পী, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সংগীতভুবনের সবার জন্যই।

বড়ো অসময়ে তিনি চলে গেলেন। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের দারুণ খরায় আরো র্দীঘদিন আমাদের মাঝে তাঁকে প্রয়োজন ছিল। যেন মনে হয় দেশজোড়া সংগীতের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথার ওপর থেকে বটবৃক্ষের ছায়া সরে গেল। মরণ সাগর পাড়ে শান্তিতে থাকুন নীলোৎপল দা।
‘সংসারে জ্বেলে গেলে, যে নব আলোক
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক।’

লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]