শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্মরণ

ভার্সাই নগরে মধুসূদনের খোঁজে

আপডেট : ২৯ জুন ২০২০, ২২:২৩

২.
২০১৭ সালের জুন মাসে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার শেষ করে অধ্যাপক ড. হান্স হার্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্যারিসের পথে সকালের ট্রেনে একাই রওনা হলাম। ভরসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র শেখ জাহিদ উর রশিদ। ও দীর্ঘদিন প্যারিসে

বাস করছে। ৩৫০ কিমি বেগে চলা ট্রেনটি স্থানীয় সময় বেলা ১২ টায় প্যারিস পৌঁছাল। ছাড়তে ২০ মিনিট বিলম্ব হওয়ায় সারা পথে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে করতে পৌঁছানোর নির্দিষ্ট সময় ধরে ফেলল দ্রুতযানটি। ট্রেন থেকে নেমে জাহিদের আয়োজনে হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হয়ে পড়লাম।
প্রথমে লুভর, তারপর আইফেল টাওয়ার, নটর ডেম গির্জা, প্যারিস গেট, আরেকটি ঐতিহ্যিক ক্যাথিড্রাল দেখে রাতে ফিরে আসা। কয়েক ঘণ্টায় প্যারিসের বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখানোর কৃতিত্ব অবশ্যই জাহিদের। কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দিয়েছি, ভার্সাই নগরে মধুসূদনের বাসস্থান দেখতে যাওয়ার
ব্যবস্থা করতেই হবে।সে কথা রেখেছিল।
পরদিন জাহিদ নিয়ে গেল ভার্সাই শহরে। মেট্রো যোগে ওর প্যানটিন (Pantin) এলাকা থেকে গার সাঁ লেজার (Gare Saint-Lazare) স্টেশনে এসে টিকেট নিয়ে RER-C ট্রেনে উঠে যাত্রা শুরু করি।প্যারিস নগর ছেড়ে যাচ্ছি শহরতলির দিকে। দূর থেকে সুউচ্চ আইফেল টাওয়ারের চূড়ার
দিকে তাকাতে তাকাতে ট্রেনের গতিপথে চোখ যায়; দেখতে পাই পাহাড় আর অরণ্যের পথ অতিক্রম করছি আমরা। মহানগরের বাইরে ছোট ছোট স্টেশনগুলো নিরিবিলি- থামলে এক-দুজন যাত্রী যোগ হচ্ছে। আমরা হাত-পা ছড়িয়ে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি কৌতূহল নিয়ে। আবাসিক
বাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে স্নিগ্ধতায় ভরা প্রকৃতির আলিঙ্গনে ঋদ্ধ।
সব স্টেশনে থামতে থামতে অবশেষে এক ঘণ্টা পরে ভার্সাই শহরের ‘গার দ্য ভার্সাই শনতিয়ের’ (Gare de Versailles Chantiers) স্টেশনে এসে নামি। স্টেশন থেকে বের হয়েই মূল সড়কে আমরা। বিস্ময় নিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছি। খুঁজছি প্রায় ১৫০ বছর আগের সময়কে। যখন বাংলা ভাষার এক অসহায় কবি সপরিবারে এই শহরটিতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে চলেছেন। আজকের ভার্সাই অনেক সাজানো-গুছানো। ঊর্ধ্বমুখী বিল্ডিংগুলো একই উচ্চতায় বিন্যস্ত। সড়কগুলো পরিকল্পিতভাবে সমগ্র শহরকে আলিঙ্গন করে আছে। বড় বড় বৃক্ষরাশি দেখে সহজেই মনে হবে এটি একটি পুরোনো শহর। উল্লেখ্য, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় মধ্যযুগেই ভার্সাই প্রথমবারের মতো ফ্রান্স রাজার অধীনে আসে। একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, এই গ্রামটি দুর্গ আর সন্তদের নামে সুন্দর সুন্দর গির্জার স্থাপত্যে অপরূপ হয়ে ওঠে। এটি ছিল কৃষিকাজের জন্য বিখ্যাত। মানুষের কঠোর শ্রমে গ্রামে সমৃদ্ধি এসেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে এটি ফ্রান্সের সমৃদ্ধিময় একটি বসতি হলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে প্লেগের মহামারি তথা ব্ল্যাক ডেথ এবং শত বছরের যুদ্ধ নিয়ে আসে এর ধ্বংস। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শত বছরের যুদ্ধের শেষে, গ্রামটি পুনরায় জেগে ওঠে। সেসময় সেখানে কেবল ১০০
জন লোকের বসতি ছিল। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ভার্সাই যৌবন ফিরে পেতে থাকে। মধুসূদন ১৮৬৩ সালে যখন সপরিবারে এই শহরে উপস্থিত হন তখন এর জনসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের মতো। বিখ্যাত ফরাসি যোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) এই ভার্সাই নগরে একটি রাত যাপন করেছিলেন।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে ভার্সাই জেনেরো (সড়ক) ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই ‘রু দ্য লা এতা জেনেরো’তে। ১২ নম্বর বাড়ি খুঁজে বের করি- যেন গোলাম মুর্শিদের গ্রন্থে পড়া সেই বাড়ির বর্ণনাকে মেলানোর চেষ্টা করতে আমরা এখানে এসেছি।
১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত তিনতলা এই ভবনের দোতলায় থাকতেন। ভবনটির লাল দরজার ওপরে লেখা ১২ নম্বর। তবে অযৌক্তিক ও সহজে নজরে না আসার মতো জায়গায় থাকা একটি নাম ফলক ভবনের প্রথম তলায় দুটি কক্ষের বাম দিক থেকে চতুর্থ এবং
পঞ্চম জানালার মধ্যে স্থাপন করা আছে। স্মৃতিফলকটি প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাস স্থাপন করেছিল বলেই কবিকে ‘ইন্ডিয়ান পোয়েট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে বলে রাখা দরকার, কবির বাসস্থানের স্মৃতিফলকটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দর করে পুনরায় টাঙানো
প্রয়োজন। রাজপ্রাসাদের বাগানের ‘ক্যাফে বারে’ কবির একটি আলোকচিত্র রাখার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। বিশাল জানালার দিকে তাকিয়ে স্মরণ করি- দোতলার দুটি কক্ষে হেনরিয়েটা ও তাদের সন্তানদের সাথে কবির নিষ্ঠুর সময় যাপন করার কথা। প্রবাস জীবন এটিই প্রথম নয়। কারণ তিনি
১৮৪৮ সালে অপরিচিত মাদ্রাজেও নিজের পরিচিত এলাকা ছেড়ে জীবন কাটিয়েছেন। ১৮৫৬ সালে সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে যখন সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত তখন একটি সনেটে যে ভাবের কথা ব্যক্ত করেছেন যার সঙ্গে ভার্সাই জীবনের হুবহু মিল রয়েছে। ১৮৬০ সালে লেখা যা ‘বঙ্গভাষা’ নামে ‘চতুর্দশপদী কবতিাবলী’তে সংকলিত তাতে আছে-
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;
মিলে গেল অনেক কিছু। কারণ পরদেশ ভার্সাইয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণের মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁর। আর কবি পরিবারের অনাহার, অনিদ্রাময় কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। এমন এক সময়ের ঘটনা ছিল যখন তাঁর ইংল্যান্ডে থাকার সামর্থ ছিল না বলে ভার্সাইতে চলে আসতে হয়েছিল। ফেরার
পর সীমিত অর্থ দ্রুত শেষ হলে তিনি ও হেনরিয়েটা দুঃস্বপ্নে দিন কাটিয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে বিদ্যাসাগরের দানশীলতায় পুনরায় লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ায় ফিরতে পেরেছিলেন। ভার্সাইয়ে অবস্থানকালে আত্মসম্মানবোধ ও অতি সংবেদনশীলতা তাঁকে চাকরি খুঁজে আয় করার ইচ্ছেকে নিরস্ত করেছিল।  তবে কবির দুঃখ ও কষ্টের কথা মনে পড়লেও বাসাটি খুঁজে পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হই। আগেই বলেছি, বাড়িটির জানালাগুলো বিশাল। তবে বাড়িটি সাধারণ মানের। একটি গ্যাস স্টেশনের সামনের দিকে এই তিনতলা বিল্ডিং যার উজ্জ্বল লাল দরজা সহজেই চোখে পড়ে। ভবনের গ্যারেজ স্পেসে আছে একটি গ্রাউন্ড স্টোর এবং একটি পুরোনো দোকান, যার জানালাগুলোও বড় বড়। নিচতলার একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টও দেখা গেল। বিদ্যাসাগরের সহায়তা পাবার পর কবি এই ১২ নম্বর বাসাটি বদল করেন এবং ভার্সাই রাজপ্রাসাদের কাছে একটি ভালো বাসায় উঠেন। সেখানে ১৮৬৭ সালের ২ আগস্ট হেনরিয়েটা তাদের তৃতীয় পুত্র অ্যালবার্ট জর্জ নেপোলিয়নের জন্ম দেন। ওই বাসার ঠিকানা ৬ নম্বর রু মোপাসাঁ। ১৮৬৯ পর্যন্ত হেনরিয়েটা ওই বাসায় বাস করেছেন কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। গুগল সার্চ দিয়ে দেখতে পাই এই জায়গা থেকে বিশ্বখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। কাছেই সেন্ট লুইস এবং আরো কয়েকটি ক্যাথিড্রাল। বাড়িটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, এখান থেকে তিনি ট্রেন যোগে নিশ্চয় প্যারিসে গেছেন। কারণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে লেখা এক পত্রে মহানুভব যে ফরাসি নারীর কথা লিখেছেন তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ট্রেনে। ভাবতে থাকি এই শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত ভার্সাই প্রাসাদ। সেখানেও নিশ্চয় তিনি প্রায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারণ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর ওই প্রাসাদ থেকে রাজধানী প্যারিসে স্থানান্তরিত হয়। ১০০ বছরের কেন্দ্রস্থল পাল্টে যায়। মধুসূদন যখন সেখানে বসবাস করছেন তখন সেটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। আর প্রাসাদের পিছনে বিশাল বাগানের লেকের পাড়ে পুরোনো ‘ক্যাফে বারে’ তাঁর পদচারণা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমি ভাবছিলাম কবির জীবনের দুর্ভোগ, কষ্ট আর বেদনায় মোড়া এই বাসস্থল নিয়ে। এই নগরই তাঁকে বেঁচে থাকার জন্য নিদারুণ দুঃখের মধ্য দিয়ে চালিত করেছে, এই বাসাতে থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন। দুর্ভোগকে জয় করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

৩.
মাইকেল মধুসূদন দত্ত দু’সন্তানসহ স্ত্রী হেনরিয়েটাকে মাসোহারার বন্দোবস্ত করে রেখে বিলেতে পৌঁছান ১৮৬২ সালের ৯ জুন এবং ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য লেখাপড়ার কাজও শুরু করেন। সূচনায় তিনি চিন্তা মুক্ত থাকলেও স্বজনদের প্রতারণায় হেনরিয়েটা ১৮৬৩ সালের ২ মে লন্ডনে এসে হাজির হোন। অর্থাভাবে মধুসূদনের আইন অধ্যয়ন ব্যাহত হয়। এরপর তিনি পত্তনিদার ও বন্ধুদের কাছে ৮টি পত্র লেখেন। সেসব পত্রের কোনো জবাব তিনি পাননি। জীবনীগ্রন্থ অনুসারে আমরা জানতে পারি, প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে ১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে কবি সপরিবারে ফ্রান্সে উপস্থিত হন। প্রথমে প্যারিস এবং পরে ভার্সাই শহরে বাস করতে থাকেন। হাতের টাকা শেষ হলে সেখানে বাসা ভাড়া বাকি পড়ে, ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ফলে পাওনাদারদের তাড়নায় এবং ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় জেলে যাবার উপক্রম হয়। স্ত্রী-সন্তানদের চ্যারিটেবল ইন্সটিটিউটে পাঠানোরও সম্ভাবনাও তৈরি হয়। হেনরিয়েটার অলঙ্কার, গৃহসজ্জার উপকরণ এবং গ্রন্থাদি বন্ধক দেওয়া ও বিক্রয় করে বেঁচে থাকার রসদ জোটাতে হয়। এমনকি কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সংবর্ধনায় দেয়া উপহার কবি প্রিয় রুপোর সুদৃশ্য পানপাত্রটিও বন্ধক দিতে বাধ্য হন। এতে পুত্র-কন্যাদের  কয়েকদিনের খাবারের খরচ চলেছিল।বিদ্যাসাগরের সাহায্য পাবার পর ১৮৬৫ সালের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে এসে ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দেন। ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টার হয়ে বের হন। পরিবারকে ফ্রান্সে রেখে ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি কবি ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। মূল লক্ষ্য ছিল পুত্র-কন্যাদের য়ুরোপীয় শিক্ষাদান।
১৮৬৪ সালের জুন মাসের ২, ৯, ১৮; জুলাই মাসের ৪, ১১; আগস্ট মাসের ২, ১৮; সেপ্টেম্বর মাসের ২, ১৮; ডিসেম্বর মাসের ১৮ ও ২৬ এবং ১৮৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি বিদ্যাসাগরকে পত্র লিখে সাহায্য পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মধ্যে বন্ধু গৌরদাসকেও ১৮৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর এবং ১৮৬৫ সালের জানুয়ারিতে পত্র লিখে বিস্তৃত পরিসরে নিজের অবস্থা জানিয়েছিলেন।  
লক্ষণীয়, দারিদ্রদশাকে গোপন না করে খোলামেলাভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পত্র লিখেছিলেন তিনি। ১৮৬৪ সালের ৯ জুন জানাচ্ছেন জনৈক ফরাসি নারী তাঁকে বাঁচিয়েছেন। পুরো পরিবারকে সহানুভূতি দেখিয়েছেন। বাড়িওয়ালাকে ওই সুন্দরী নারী বলেছেন, বাকি দিনগুলোতে থাকতে দেয়ার জন্য তিনি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছেন।
অন্যদিকে জানা যাচ্ছে, উপবাস করে মরার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পরিচিত-অল্প পরিচিতদের কাছে হাত পেতেছেন কবি। আসলে ভার্সাই জীবনের শুরুতে অসুখী ও দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করেছেন মধুসূদন। এরই মধ্যে তিনি জানাচ্ছেন, ফরাসি, ইতালি, জার্মান ও পুতর্গিজ ভাষা শিক্ষার কথা। দুঃসময়ের ভেতর তিনি বিদ্যাসাগরকে আরো জানিয়েছেন, মহাকাব্যের কবি ট্যাসো হচ্ছেন ইউরোপের কালিদাস।
৪.
১২ নম্বর বাসা ছেড়ে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটতে থাকি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদের আঙিনার দিকে জাহিদ নিয়ে চলে।প্রাসাদটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। লুভর জাদুঘর ও আইফেল টাওয়ারের পর ভার্সাই রাজপ্রাসাদ সর্বাধিক
পরিদর্শনকৃত স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে প্রতি বছর প্রায় কোটির ওপরে দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
 স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের কক্ষ ও সাজ-সজ্জা দেখার আমার আগ্রহ ছিল না; কেবল ওকে বলেছিলাম খুঁজে বের করো মধুসূদনের পদচিহ্নের জায়গাগুলো।
অবশ্য প্রাসাদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ১৭৮৩ সালে ‘পিস অব প্যারিস’ চুক্তি এখানে স¤পাদিত হয়, ১৯১৯ সালে ‘ভার্সাই চুক্তি’ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয় এই রাজপ্রাসাদ থেকেই। রাজা চতুর্দশ লুই ১৬৫১ সাল থেকে ভার্সাইয়ে যাতায়াত শুরু করেন যখন তার বয়স ১২। শহরতলির এই জায়গায় প্রথম দিকে শিকারের উদ্দেশ্যে এলেও পরে রাজপ্রাসাদের পুনর্নির্মাণ ও সড়ক প্রশস্ত করতে মনোযোগী হন তিনি। ফলে বিশ্রাম ও বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয় নিজের বাসস্থান। সপ্তদশ শতকে রাজ-স্থপতিকে রাজা ইউরোপের সর্বাধিক সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন ও বৃহৎ পরিসরে উদ্যান তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬৮২ সাল থেকে চতুর্দশ লুইয়ের প্রাসাদটি ফ্রান্সের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় যা ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তি ঘটে। তবে প্রাসাদের পিছনে ১৬৬০ সাল থেকে বৃহৎ বাগানটি গড়ে উঠতে থাকে। ১৭৭০ সালে উত্তর দিকে পঞ্চদশ লুইয়ের সময় নির্মিত অপেরা হাউজটি চারিদিকের বৃক্ষবেষ্টনীতে অপরূপ হয়ে আছে।  রাজপ্রাসাদের পিছনে এলে দেখা যাবে মনোরম লেক, ঝর্ণা, বিচিত্র ভাস্কর্য, জ্যামিতিক ফুলের বিছানা এবং গাছের খাঁজে সজ্জিত বাগান। ফলের গাছগুলিতে প্রচুর কমলা ধরে আছে, বিচিত্র রঙের বিভিন্ন পাখির হৈচৈ
তো আছেই। বৃহৎ লেকটি চলে গেছে দক্ষিণের প্রান্ত পর্যন্ত। বাগানে ঢুকে কিছু দূর এগিয়ে গেলে লেকের শুরুতে পুরোনো দিনের একটি ছোট ‘ক্যাফে বার’ আছে।প্যারিসের বাঙালি মাত্রই জানেন, এই ক্যাফেতে মধুসূদন এসে বসতেন। সময় কাটত প্রকৃতি অপরূপ শোভা দেখে। মনে পড়ত বাংলার
পথ-প্রান্তরের কথা।
ঘুরছিলাম ‘ক্যাফে বার’কে কেন্দ্র করে। লেকের পাশে ছোট এই কফি শপের ভেতরটাও বেশ গুছানো। সামনে লেকের দিকে মুখ রেখে বসে বসে কফি পানের কথা কল্পনা করলাম। এখন রাজপ্রাসাদের সামনে দিয়ে ঢুকে পিছনের এই বাগানে আসতে হয়। কিন্তু মধুসূদনের সময় কফিশপের উল্টো দিক দিয়েও বাগানে প্রবেশের পথ ছিল। এখন যতটা পরিপাটি এবং সযতেœ লালিত বাগানের গাছ-গাছালি ঠিক দেড়শ বছর আগে এরকমটা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পিত উদ্যানের বৈশিষ্ট্য যে তখন থেকে তৈরি হয়েছিল এটা ইতিহাসের তথ্য সমর্থন করে। অনন্য সব বৃক্ষের সমারোহ এই বাগানে। পুষ্পিত বর্ণের সমাহার চারিদিকে, সবুজের মলাটে আবৃত পুরো এলাকাটি। ভাল লাগছিল এক বাঙালি কবি এই রাজপ্রাসাদের আঙিনায় চরম কষ্টের মধ্যেও ঘুরে বেড়িয়েছেন এই ভেবে। হয়ত সন্তানদের নিয়েও এসেছেন। লেকের পাশে বসে গল্প শুনিয়েছে তাঁর নিজের বাংলা প্রকৃতির।
হয়ত হেনরিয়েটা তখন কবিকে মনোবল হারাতে নিষেধ করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন কাব্য রচনায়।তখনকার প্রকৃতি আর দেড়শ বছর পরের এই প্রকৃতি জীবনের গান গেয়ে চলেছে। মধুসূদন সেই প্রকৃতির চিরকালীন সংগীতের মূর্ছনায় জেগে ওঠা প্রাণ।যিনি সহজেই পরাজয় মেনে নেননি। সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন। তাই আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে।