শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শ্রদ্ধা

সোনালী কাবিন’ থেকে `বখতিয়ারের ঘোড়া’-র পথ পরিক্রমা: বিতর্ক-বিচ্যূতি পেরিয়ে কবির মূল্যায়ণ

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২০, ০০:০৪

১১ জুলাই ছিল বাংলা ভাষার অন্যতম শক্তিমান কবি তবে রাজনৈতিক নানা ভুল-বিচ্যূতির জন্য একইসাথে বিতর্কিত কবি আল মাহমুদের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের বৃহত্তর কুমিল্লা এলাকার তিতাস নদীর পাড়ের সন্তান এই কবি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল-কলেজের প্রথাগত তেমন ডিগ্রি তাঁর নেই। কবির নিজের ভাষাতেই, `আম্মা বলেন, পড়রে সোনা, আব্বা বলেন, মন দে, পাঠে আমার মন বসে না, কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’ তবে ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে ১৯৫৪ সাল থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাসে লেখালিখির সুবাদে ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এ-সময় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত `কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি কবিতা ছাপা হলে সমসাময়িক কবি-মহলে তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত `সমকাল’ পত্রিকায় তখন তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। কলকাতার সাহিত্য সভায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা যেমন আঁজলা ভরে পূর্ব বাংলার বরিশালের ভাঁট ফুল, আশ শেওড়া, বুনো ধুন্দুল, বেত ফল উপহার দিয়েছিল, আল মাহমুদ সম্ভবত: পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় প্রধান কবি যিনি পশ্চিমের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইয়েটস-এলিয়ট-এজরা পাউন্ড শাসিত কাব্যভাষার প্রভাবে বাংলা কবিতায় ত্রিশের পঞ্চকবির কাব্যভাষায় মুগ্ধ ঢাকার শামসুর রাহমান বা শহীদ কাদরীর বিপরীতে বা সমান্তরালে তিতাসের চর, ভাটি বাংলার জনজীবন, লোকায়ত নর-নারীর প্রেম তাঁর কবিতার বিষয় করে তোলেন। ব্যক্তি মাহমুদের জীবন কবি আল মাহমুদের কবিখ্যাতিকে ছাড়িয়ে তর্কে-বিতর্কে আলোড়িত হয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আল মাহমুদ সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে কবি `গণকণ্ঠ’ নামক সরকার বিরোধী অবস্থানের পত্রিকায় যোগ দেন। এসময় তিনি কিছুদিন জেলবন্দীও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগে সহ-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২-৭৫ সময়কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধু এইএসএসসি ডিগ্রিও অর্জন না করা কবিকে শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক পদে নিযুক্তি দেন। আল মাহমুদ আনুমানিক ১৯৬৯-৭২ সময়পর্বে বঙ্গবন্ধুর গভীর প্রশংসা করে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা পরে তাঁর কোন বইয়ে আর অন্তর্ভুক্ত করেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বেশ কয়েক বছর পর আল মাহমুদ শিল্পকলা একাডেমিতে উচ্চপদে থাকার সময়ই চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনীতে অনেকগুলো ছবির ভেতর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছবি রাখায় আল মাহমুদ শেষমূহুর্তে সেই প্রদর্শনী হতে দেননি। পরে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তিনি অবসর নেন। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৩০-এর বেশি। তাঁর কাব্য প্রতিভা নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীর হত্যা ও আনুমানিক চার লক্ষ নারীর গণধর্ষণে পাক বাহিনীকে সার্বিক সহায়তা প্রদানকারী রাজনৈতিক দল জামায়াত-এ-ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নানা সভায় বক্তব্য প্রদান বা একাত্তরে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞে পাক বাহিনীর মূল সাহায্যকারী ও কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের জীবনী রচনা করে সত্যিই নিজের কবিপ্রতিভাকে দু:খজনকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আগের লোকায়ত বাংলার কবি পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোয় হয়ে ওঠেন দূর মরু জীবনাচারের উপাসক। সেই সব এজেন্ডাবাহী কবিতাগুলো আদৌ কি কবিতা হয়ে উঠেছে? চলুন- তাঁর জীবনের শুরু ও শেষের পদাবলীর এক নির্মোহ মূল্যায়ণেই বরং যাওয়া যাক। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘতম কবিতা `সোনালী কাবিন’-এর কয়েকটি পংক্তিই পুনরায় পড়ি বরং। না, তার আগে এই গ্রন্থের `প্রকৃতি’ কবিতার কয়েকটি চরণই দেখি। যদিও কবিতাটি প্রথাগত `মেল গেজ’ থেকে লেখা বা নারীকে এখানে যৌন বস্ত হিসেবেই দেখা হয়েছে তবু কবিতাটি বিশিষ্ট একদমই বর্ষণসিক্ত গ্রামে ভেজা মাটি কর্ষণরত কৃষকের অবলোকনকেই নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারায়: ‘কতদূর এগোলো মানুষ!/কিন্ত আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে/ আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে/ কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে/ ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার।/বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়/ যে নারী উদাম করে তা সর্ব উর্বর আধার।’ একই কবিতায় একটু পরেই কবি আবার উপমা দিচ্ছেন, `চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপ টিপ শব্দে/সারাদিন জলধারা ঝরে।’ এই বইয়েরই চতুর্থ কবিতা `কবিতা এমন’- এ কবি লিখছেন, ‘কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর/ ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান/ চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে/ নি:স্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।... কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ ম্লানমুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/ গোপনে চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/ কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে ধাক্কা খাই। এক সময় বাংলাদেশের গ্রামে ইসলামী ধাঁচের বিদ্যায়তন মাদ্রাসা বা মক্তবেও মেয়েরা চুল খোলা রাখতে পারতো। অথচ আজকের বাংলাদেশে শহুরে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায়তনেও `হিজাবে’-র ছড়াছড়ি। কবি নিজেই পরবর্তী সময়ে, আদর্শিক অবস্থান বদলানোর পর `বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থে `নীল মসজিদের ইমাম’ কবিতায় দয়িতা নারীকে বলছেন, ‘...ঝড়ো বাতাসের/ ঝাপটা থেকে তোমার উড়ন্ত চুলের গোছাকে/ ফিরিয়ে আনো মুঠোর মধ্যে। বেণীতে বাঁধো/ অবাধ্য অলকদাম।/ কেন জিনেরা তোমার কেশদাম নিয়ে খেলা করবে ?’ গত পাঁচ-দশ বছরে হুট করে পাল্টে যাওয়া (মুক্তকেশী নারীদের অধিকাংশের সহসা `হিজাবি’ হয়ে ওঠা) বাংলাদেশের জন্য মতাদর্শিক ক্ষেত্র কি এভাবেই প্রস্তত করেছে জামায়াত-ই-ইসলামী অতীতের এক প্রগতিবাদী কবিকে স্বপক্ষভুক্ত করে? অথচ এই কবিই `সোনালী কাবিন’ কবিতায় `আসে না আর’ কবিতায় কেমন অনুপম প্রেমের আর্তিতে বলছেন-
‘পাহাড়পুরের পাথর রেখে বামে 
পেরিয়ে খাল, পুরোনো গড়খাই 
এগোলে কেউ আসে না আর ঘরে 
এই কথা তো জানতে, তবু কেন 
হাটের মাঝে আসতে দিয়েছিলে?’ 
‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাটি আবার পুরো `সোনালী কাবিন’ গ্রন্থে ভিন্ন মেজাজের। গল্পের নায়ক ট্রেন ধরতে গিয়ে ট্রেন ফেল করে। অথচ, তারই অন্য ভাই-বোনেরা কি দূর্দান্ত চটপটে! কবির ভাষায়- 
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। 
ফরহাদ আধ ঘন্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। 
নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।’ 
আর বাংলা কবিতার চির অমর চির অপরূপ চির অবিনশ্বর কবিতা `সোনালী কাবিন’ যা বিটোফেনের `নাইন্থ সিম্ফনী’ যেমন গোটা ইউরোপীয় মহাজাতির সম্মিলিত গৌরবের প্রতিধ্বনি, ঠিক তেমনটাই গোটা বাংলা ও বাঙ্গালীর সম্মিলিত আস্থা ও স্বপ্নের অনুরনণ জানায়: ‘যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মানিনী/ একদা তারাই জেনো গড়েছিলো পুন্ড্রের নগর/ মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জানিনি/ কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।/ আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে/ পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পট্টিকেরা পুরীর গৌরব,/ …অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন/ করতোয়া পার হয়ে এক ইঞ্চি এগোতো না আর,/ তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?/ ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বার বার!’ সত্যিই অবাক না হয়ে পারি না যে এই একই কবি কি `বখতিয়ারের ঘোড়া’-য় লিখেছেন, ‘মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে/ মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;/ আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।’ শৈশবে আল মাহমুদের অনেক ছড়া আমাদের মুখে মুখে ফিরতো। স্কুল জীবনে তাঁর ছড়া বা কবিতা আমাদের অনেক মুখস্থ করতে হয়েছে, 
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী ভাসে!’ 
আমাদের শৈশবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামের মঙ্গোলয়েড বৌদ্ধ জনপদের লিয়ানা নামে এক চাকমা মেয়ের কথা বুকে গেঁথে যায়-
লিয়ানা গো লিয়ানা সোনার মেয়ে তুই, 
কোন পাহাড়ে তুলতে গেলি- জুঁই। 
বন-বাদাড়ে যাইনি মাগো ফুলের বনেও না, 
রাঙা খাদির অভাবে মা পাতায় ঢাকি গা।
উদ্ধৃতি দিতে গেলে শেষ হবে না। কবি আল মাহমুদ কিন্ত অনুবাদও করেছেন কিছু কবিতা। হোর্হে লুইস বোর্হেস বা হাইনরিশ হাইনে কি এডগার এলান পো-র পাশাপাশি মৃদুভাষী জাপানী কবিতাও অনুবাদ করেছেন কিছু। তাঁর অনুবাদ কুশলতাও প্রশংসার্হ। তাঁর অনূদিত কবিতাগুলোর মধ্য থেকে জাপানী কবি মিট্সুনে উবশ কওচি রচিত `শ্বেত মল্লিকা বনে’ সত্যিই অনন্য-
ক্রিশেনথিমাম তুলতে গিয়ে শাদা 
মনে লাগল ধাঁধাঁ- 
কোন কুসুমের পাপড়ি রঙিন 
কার বা সফেদ গা । 
বুঝতে পারি না। 
তার চেয়ে আজ বাগান জুড়ে জমুক কুয়াশা। 
ব্যক্তি জীবনে মতাদর্শিক অন্যায় বা সুবিধাবাদীতা (বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশার তাঁর প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে নিযুক্তি ও পরে তাঁরই হত্যা পরবর্তী সময়ে সেই নেতারই একটি ছবি চিত্র প্রদর্শনীতে রাখতে চাওয়ায় শাহাবুদ্দীনের চিত্রকলা প্রদর্শনী পুরো বাতিল করে দেয়া) যতই থাক তাঁর, তিতাস পাড়ের এই `চাষার ছাওয়াল’ চরের পানকৌড়ি, শুদ্র-বৌদ্ধ-ধর্মান্তরিত মুসলিম তথা পূর্ব বাংলার কৃষক জনপদের শ্রম ও ঘামের, শ্যামাঙ্গ নর-নারীর প্রেম ও কামের কাব্যই লিখে গেছেন তাঁর শুরুর কবিতাজীবনে- জানিত না যা যত আর্যের যুবতী! ভূপেন হাজারিকার শেষ জীবনের বিজেপিতে যোগদানের জন্য তাঁর অমর সব গান কি আমরা বাতিল করে দেব বা দিতে পারি? এ প্রশ্নের মীমাংসা করা বেশ কঠিন। তাই পক্ষিণীর গোত্র কখনোই ভুল করে না যে নিষাদ, তিনি সেই নিষাদের কবি, শবরের কবি হিসেবেও আমাদের মাঝে থেকে যাবেন।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]