বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিরুপম চক্রবর্তী-র একগুচ্ছ কবিতা

আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২০, ১২:২৮

নিজস্ব বাতাস


প্রত্যেকেই পরে নেয় নির্বিকার পাংশুটে মুখোশ
শহুরে রাস্তায় তারা হেঁটে যাবে ইনকগনিটো
নেহাৎই নগণ্য লোক: হয় রাঁধে নয় চুল বাঁধে
শহর উগরে দ্যায় একরঙা ভিড় শুধু
তবু কেউ কবিতার ফাঁদে
ধরা পড়ে গেছে ভেবে প্রবল বিলাপ ক’রে কাঁদে!

তবু কোনও বিরল দুপুরে
তবু এই নিরানন্দ মুখোশের নির্লিপ্ত শহরে
স্যাতলা বাড়ির ছাদে রামধনু উঠে দোটানায়
মুখোশের নিচে দ্যাখে প্রতিটি মুখশ্রী বেয়ে
নিজস্ব বাতাস বয়ে যায়!


সাপেদের শিস


একদিন ভালোবাসা ভুল ক’রে তাকে ভালোবেসে
ফিরবে ফিরবে বলে ফেরেনি তো জানি অবশেষে
হয়তো গিয়েছে দূর দেশে
হয়তো বুঝতে পারেনি সে
ছড়ানো জীবনগুলো ভ’রে ভ’রে ওঠে শুধু
ফেনাঝরা সাপেদের বিষে।।

একদিন ভালোবাসা ভুল ক’রে তাকে ভালোবেসে
ঠিকই ফিরে এসেছিলো ছেঁড়াখোঁড়া পুরোনো স্বদেশে
জানি না তো সে কি চেয়েছিলো
জানি না তো সে কি পেয়েছিলো
বাতাস হ’য়েছে ভারি অবিরাম সাপেদের শিসে
বেরোলো লুকোনো ছুরি, কেঁপে ওঠে ছায়াগুলো
দুলে ওঠে ফণা হিস্-হিসে।।


বিচ্ছিন্ন শব্দের গল্প


বিচ্ছিন্ন শব্দের কাছে যেন কিছু ঋণ পড়ে আছে।
যেসব শব্দকে আমি একদিন হেলাভরে কবিতার গ্রাসে
নিয়ে এসে তারপর সবকিছু ভুলে গিয়ে চলে গেছি চুপচাপ
দূর পরবাসে,
সেসব শব্দেরা আজ কেন যেন বারবার ফিরে ফিরে এসে
ঝমাঝম বেজে ওঠে মাথার ভেতরে এক ক্লান্ত দিন শেষে,
যেন অন্ধকার থেকে কিছু কান্না ঝরে ঝরে পড়ে
যেন কিছু ম্লান শব্দ দাঁড়িয়ে থেকেছে শুধু সার সার
বিনা ব্যবহারে;
তাদের যে মুখ নেই, নাক নেই, চোখ নেই
শুধু তীক্ষ্ণ নখের বাহার,
খালি কবিতার পাতা শিরশির করে ওঠে
আঁচড়ে আঁচড়ে,
সদ্য জবাই হওয়া মুণ্ডহীন মোরগেরা ঝটপট করে যায় ডানা
(আমরা আহ্লাদে আটখানা!)
আমাদের এই গল্পে অঙ্গহীন, মৃত্যুহীন
কবিতারা প্রহর জেগেছে।


পরাবাস্তব দিবাস্বপ্ন 

 

জ্যামিতির কারুকাজহীন এক মুখশ্রীর কাছে
হাত পেতে দাঁড়ায়েছে পিকাসোর কবুতর, আর এক বিষণ্ণ বালক।
রৌদ্রসিক্ত শহরেতে সারাদিন আইসক্রিম বেচে হাক্লান্ত জীবনানন্দ,
সেও বুঝি বলিয়াছে: পায়রারা, ইহাদের দেখিয়াছি আমি।
সকলেই দেখিয়াছে, ব্যতিক্রম মম ত্রিনয়ন, 
আমি রৌদ্র দেখিয়াছি, এই দেশে আজিকে উৎসব
শোণিত স্রোতের প্রায় ঝরিতেছে সূর্যের কিরণ
মুণ্ডহীন দেহগুলি কদম কদম হাঁটে উত্তেজক সংগীতের তালে
হস্তপদহীন এক উচ্চকিত ব্যান্ডমাস্টার 
বাজেয়াপ্ত করিতেছে তাহাদের শিরস্ত্রাণগুলি।
তথাপি এমত স্বপ্নে সকলেই পরিতৃপ্ত, আনন্দে অটুট
অট্ট অট্ট হাসিতেছে নরনারী নির্বিশেষে
সকলেই মহাব্যস্ত, ছাতাটি খুলিয়া বলে: আসি ভাই, বড্ড কাজ আছে!

আমার এখানে কোন কাজ নাই: এই গ্রহে একাকী মানব।
দর্শকের মত আমি এসকল স্বপ্নের ভিতরে ক্রমাগত হেঁটে চলি,
রুধিরের স্রোত বহে নদীবক্ষে: সভ্যতার সুচারু প্লাবন,
সেই নদী পার হয়ে কে আছো হে সন্তরণপটু
চলো যাই জ্যামিতির কারুকাজহীন ওই আধোচেনা মুখশ্রীর কাছে।
স্থির হয়ে দাঁড়ায়েছে সেইস্থানে পিকাসোর কবুতর আর এক বিষণ্ণ বালক,
দুজনেই গুলিবিদ্ধ:
কোনো জন্মে স্টিগমাটিক তাহারা ছিলোনা তবু 
তাহাদের চক্ষু বাহি অশ্রুর বিকল্পে আজ অলৌকিক রক্ত ঝরিতেছে।।


পারাচী


ব্রাসিল নামক এক মনোরম দেশ আছে সুদক্ষিণ দিগন্ত সকাশে
তাহারে সমুদ্র এক চারুকৃত নীবীবন্ধে বাঁধে।
সে সমুদ্রপারে আছে মনোরমা পারাচী নগরী
জোয়ারে প্লাবিত হয় প্রতিদিন – সেই বারি মুকুর সদৃশ;
সুরম্য হর্মরাজি আর এক চপলা বালিকা
প্রতিদিন সেইস্থানে আপনার প্রতিবিম্ব দ্যাখে।

ট্যুরিস্ট তুমি কি কভু হারায়েছো পথ হেথা? মোর নাম কপালকুণ্ডলা,
মোর নাম চম্পাকলি, এইস্থানে আমি ইসাবেলা
রাজার নন্দিনী আমি, পিতা মগ্ন ফুটবল ক্রীড়ায়
পারাচী নগরে বাস, জলমগ্ন মায়ামুকুরেতে
ফুটিছে আমার ছবি (হৃদ্‌পদ্মে পারিলে রাখিও!)
ক্লান্ত আমি, ভগ্ন আমি,
ফুটিছে আমার ছবি, ফুটিতেছে আমার অতীত –
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ পারাচী যেইরূপ ছিলো।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পারাচীর বাণিজ্য বাতাস
যুদ্ধের সন্দেশ বহে – আসিতেছে রণতরী
রণমত্ত ফরাসি নাবিকবৃন্দ তরবারে পথ কাটি
হারাইবে পর্তুগিজে, স্বর্ণের রাজস্ব নিয়া তুলিবে নোঙর।
বিভোর বালুকাবেলা, ঊর্মিভঙ্গে বিহ্বলা নগরী,
কাহারে খুঁজিয়াছিলে ইসাবেলা সেইদিন? কার তরে আজও দাঁড়ায়েছো?

জোয়ারে প্লাবিত হয় এ পারাচী, সে মায়ামুকুরে আজও
বিম্বিত হয় কারা? দেখিয়াছো ইসাবেলা: রক্তাক্ত বিক্ষত মুখ,
মৃত চক্ষু এখনও তাকায়, 
সমুদ্র-জোয়ারে দ্যাখো ফেরে মৃত নাবিকেরা,
অবয়বহীন তবু ভালোবাসা চায়!


বেকুব


কে এক বেকুব কাকভোরে
নিজস্ব যাদুটোনা নাকি ব্ল্যাক ম্যাজিকের ঘোরে
হেঁটেছে স্বপ্নে স্মৃত কাঁটাঝোপে শিহরিত
কবিতার চোরাপথ ধরে।

কী হবে এসব খোঁজ পেয়ে?
আমরা যাইনি সাথে
উলঙ্গ রাজপথে
হাত পেতে দাঁড়িয়েছি
নিরাপদ গল্পগুলো চেয়ে।।

 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]