বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফিরে দেখা: গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী

আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০

স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন একজন সাহসী দেশপ্রেমিক। সময়টা ছিল ১৯৬৯। ঐ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে স্বাধীনতার দামামা বেজে উঠেছে। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণমানুষ তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ‘আগরতলা’ মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে এ দেশের ছাত্র-জনতা আন্দোলনমুখি।

১৯৬৯-এর ৮ জানুয়ারি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে শেখ মুজিবের মুক্তি, সাধারণ নির্বাচন ও জরুরি আইন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ১২ জানুয়ারি এই সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা এবং ১৭ জানুয়ারি দেশব্যাপী দাবি দিবস উদযাপিত হয়। এদিকে সফল ছাত্রসংগঠনকে একত্রিত করে ডাকসুর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে আন্দোলনের ডাক দেয়। যার মধ্যে প্রধান দাবি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি।

১৮ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। এই ধর্মঘটে পুলিশ বাধা দেয় এবং ছাত্রদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। এই প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামে। ছাত্রদের রাজপথের এই মিছিলে গুলি চলে। পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র দেশে সূচিত হয় দুর্বার আন্দোলন।

এর মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলার মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এই বর্বরতার প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পালিত হয় হরতাল।

সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহীর মানুষও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য স্থানীয় প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী সেদিন ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে বেশ কিছু ছাত্র আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খবরটি প্রচারিত হলে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জোহা স্যার খবরটি পাওয়ামাত্র এস এম হলের প্রভোস্ট ড. মাযহারুল ইসলাম স্যারকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে তাত্ক্ষণিক ঘটনাস্থলে চলে আসেন। আহত ছাত্রদের ভ্যানে তুলে চিকিত্সার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেদিন আহত ছাত্রদের রক্তে তার জামা ভিজে গিয়েছিল। তাদের চিকিত্সার ব্যবস্থা করে তিনি বলেছিলেন, ‘কাল আবার আমি এসে তোমাদের দেখে যাব।’

ঐদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চলছিল একুশের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সেদিন তিনি তাঁর শার্টে ছাত্রদের রক্তের দাগ দেখিয়ে জোরালো কণ্ঠে বলেন, ‘আহত ছাত্রদের রক্তের স্পর্শে আজ আমি গৌরবান্বিত। এরপর থেকে শুধু ছাত্রদের রক্ত নয় প্রয়োজনবোধে আমাদের রক্ত দিতে হবে।’ তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে আবারো ঘোষণা করেন—‘এরপর আর যদি কোনো গুলি করা হয়, কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সেগুলি আমার বুকে লাগবে।’

১৮ ফেব্রুয়ারি। আনুমানিক বেলা তখন সাড়ে ৯টা, ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক জোয়ানদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাঁর প্রিয় ছাত্রদের রক্ষায় তিনি ছুটে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে, নাটোর রোডের ওপারে যেখানে প্রতিবাদী ছাত্রদের গুলি করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জোয়ানরা রাইফেল তাক করে ছিল।

ড. শামসুজ্জোহা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। তিনি কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাকে বলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার। আমার ছেলেরা এখনই ক্যাম্পাসের মধ্যে চলে যাবে।’

ছাত্ররা তখন তাঁদের প্রিয় স্যারের আদেশে ক্যাম্পাসে ফিরে যাচ্ছে, এমন সময় হঠাত্ গুলি। কেঁপে উঠল সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়। পিছনে তাকাতেই সবাই দেখল তাদের প্রিয় স্যার মাটিতে পড়ে চিত্কার করছেন। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গুলি করেছে।

যে স্যার গতকালও তাদের কথা দিয়েছিলেন, কালও হাসপাতালে তাদের দেখতে যাবেন, তাঁর আর যাওয়া হলো না।

এই আত্মত্যাগী শিক্ষক সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক ভবনের সামনে চিরনিদ্রায় শায়িত। শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার নন, ড. শামসুজ্জোহা বাংলাদেশের গৌরব।

 

ইত্তেফাক/ইউবি