শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

৫০তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা 

নূর কামরুন নাহার: জীবনের মানে যেন শুধুই হাতছানি   

আপডেট : ১০ মার্চ ২০২১, ২২:৩৯

তরুণ এই গল্প লেখক বেশ কয়েক বছর ধরে সাহিত্যের অঙ্গনে চলাফেরা করছেন। কিন্তু কেউ তাকে সেভাবে লক্ষ্য করেছেন কী না আমি জানিনা। তবে আমি যে করিনি তাতে কেনো সন্দেহ নেই। তাঁর বই আমার হাতে এসে পৌঁছেছে মাত্র কয়েক মাস হল। এবং আমি একটি বা দুটি গল্প পড়ার পরপরই তাঁর অন্যান্য গল্প পড়বার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। এবং আচিরেই একগাদা গল্প ও উপন্যাসের মালিক হই। অর্থাৎ বইগুলো আমি জোগাড় করি। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই একথা ভেবে যে এই তরুণ লেখকের জীবন সম্পর্কে যে স্বচ্ছ ধারণা এবং ঠেকে ঠেকে জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁর যে অভিজ্ঞতার স য় তা যে কোনো জীবনবাদী গল্পকারকে হতভম্ব করে দিতে সক্ষম। এবং এই অভিজ্ঞতা লেখকের একদিনে অর্জন করা সম্ভব হয়নি, জীবনের প্রতিটি বাঁক তিনি তাঁর রক্তমাংস এবং অভিজ্ঞতার জারকে সিক্ত করে কলম ধরেছেন তার বর্ণনায়। তাঁর লেখা অজস্র গল্পের ভেতরে এই জীবনবোধ এত প্রখর এবং এত উজ্জ্বল যে মাঝে মাঝে মনে হয় এ কি কোনো মেয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা নাকি কোনো পুরুষের। 

কাছের জীবনকে একটু দূর থেকে দেখা এই লেখকের লেখার বৈশিষ্ট্য। নির্মোহ একটি ভাব ফলে তাঁর সব লেখার ভেতরেই বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর লেখার প্রায় চরিত্রগুলোই জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও স্বপ্ন দেখা ছাড়তে পারে না। যেমন ঢাকা শহরের একটি ফ্ল্যাটের জন্য দুই নিম্নবিত্ত বান্ধবীর আকুল এক স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন দু’জন মানুষকে জীবনের পথে চালিত করে। সাদামাটা জীবন ও জীবনের সংগ্রামকে সহনীয় করে তোলে চলার পথে। কত রকমে এবং কতরকম ভাবেই না দুই বান্ধবী ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে তাঁদের জীবনের স্বপ্নকে অর্থবহ করবার জন্য, একটি ছয়শ বা আটশ বা একহাজার স্কয়ার ফুট ঘেরের ফ্ল্যাটের জন্য , জীবনকে একটি সুস্থির পরিমণ্ডলের ভেতরে আয়ত্ব করবার জন্য,  নিজের নিজের সংসারটিকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে তোলবার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে, কিন্তু সেই স্বপ্ন তাদের পূরণ হবার নয়, কারণ এই স্বপ্নটুকু তাদের আয়ত্বের বাইরে। সর্বক্ষণ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জীবনকে চালিত করে চললেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তকমা আয়ত্ব করে ফেললেও, সংসার এবং চাকরিকে জীবনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে করায়ত্ব করে ফেললেও, অর্জনের প্রতিটি পাইপয়সা হিসাব করে খরচ করে চললেও, এবং নিজ নিজ স্বামীদের সকল সহযোগীতা করায়ত্ব করে চললেও, এই স্বপ্নটুকু তাদের পূরণ হবার তো নয়, কারণ যখনই তারা তাদের স্বপ্নকে স্পর্শ করতে যায়, স্বপ্ন যখন তাদের হাতের আওতার ভেতরে এসে পড়ে, তখনই পরিবেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, অতি বাস্তব এবং যুক্তিসই কিছু ঘটনা , যা আমাদের দেশের প্রতিটি জনগণেরই যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার অংশ, যে প্রায় ছুঁয়ে ফেলা স্বপ্নও তখন আবার উঠে যায় গাছের মগডালে।
ফ্ল্যাট কেনা আর হয় না। এবং তারপরেও কি মানুষ স্বপ্ন দেখা ছাড়ে? বা ছাড়তে পারে না। 

আর তাইতো দেখি লেখক তাঁর গল্পের শেষ অধ্যায়ে লিখছেন, ‘‘কোনো ফ্ল্যাটে সবুজ পাতাবাহার দেখলে আমি ভাবি আমার ফ্ল্যাটে ঠিক এইরকম পাতাবাহার ঝুলিয়ে দেব। একটু প্রশস্ত রাস্তার পাশে নতুন ফ্ল্যাট দেখলে লিনু ভাবে এখানেই ফ্ল্যাটটা হলে ভালো হতো। আমরা জানি হয়তো আমাদের হবে না। তারপরও আমি আর লিনু প্রায়ই গল্প করি। গল্প করতে আমাদের খুব ভাল লাগে।’’

স্বপ্ন পূরণ না হওয়া স্বত্বেও এরকম নির্মল এবং নির্মোহ ভাবে জীবনকে অবলোকন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আরেকটি গল্প তাঁর রচিত ‘‘পাঁচবোন’’। এই সাদামাটা নমের গল্পটির ভেতরে জীবনের নির্মমতা এমন নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ফুটিয়ে তোলেন যে পাঠককে গল্প শেষ করে ভাবতে বসতে হয়। সমগ্র গল্পটির ভেতরে এক ধরণের করুণতা খেলা করে যাকে হয়ত ইংরেজিতে ‘প্যাথোস’ বলা যায়। এই গল্পে কারও প্রতি রাগ বা অভিযোগ হয় না, জীবনের খেলাকে নীরবে যেন মেনে নিতে হয়। বুক চাপা কান্নাকে পাথর চাপা দিয়ে রাখতে হয়। কারণ জীবন মানেই এই। এইভাবে রিক্ততার অবগাহনে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলা। 

এভাবে প্রায় সব গল্পই নূর কামরুন নাহারের জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। উপন্যাসেও নূর কামরুন সাক্ষর রেখেছেন তাঁর প্রতিভার। মানুষের অবদমিত বাসনার ছবিকে, সংসারের একঘেঁয়েমি থেকে বেরিয়ে আসার তাড়নায়, জীবনের ছবিকে এঁকেছেন বড় সুচারু ভাবে। সব চেয়ে বেশি করে এঁকেছেন সাধারণ নিম্নবিত্ত জীবনের ছবি। জীবনকে এত ঘনিষ্ঠভাবে আর কোনো লেখক আমাদের দেশে দেখেছেন কী না আমার জানা নেই। বা থাকলেও আমাকে এভাবে স্তম্ভিত করে নি। বরং তাঁর লেখার ভেতরেই যেন আমি খুঁজে পেয়েছি জীবনের ভিন্ন ধরণের এক অর্থ। 

উপন্যাসেও নূর কামরুনের মুন্সিয়ানা উপভোগ্য। তাঁর ‘‘জলরঙে আঁকা’’ উপন্যাস নিম্নবিত্তের একটি দৈনন্দিন জীবনের উপাখ্যান। যেখানে একজোড়া তরুণ তরুণী স্বপ্ন দেখে একদিন যুগল জীবন গঠনের। বাস্তবের নির্মমতায় যা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কিন্তু তারপরও স্বপ্ন মরে যায় না। প্রেমও শেষ হয় না। প্রেম শুধু রঙ বদলায় মাত্র। সেখানে জীবনের বাস্তবতা উঠোনের রজনীগন্ধায় এসে থামে। অফিসের কোনো অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার পিতা খুশি মনে তার বাড়ির বাচ্চাদের জন্য বয়ে আনে। সেখানে কেক, সামুসা, নিমকি, স্যান্ডউইচ। যেন স্বর্গের আনন্দ খোলা ঘরে নেমে আসে। সুখের দ্যোতনায় ভাগাভাগি করে স্যান্ডউইচ খাওয়া হয়। আঃ, বইটি পড়তে পড়তে আমার মন পড়ে থাকে সেইসব শৈশবের দিনগুলোর জন্য যখন একটি বৃহৎ সংসারে সামান্য একটি পুলিপিঠার পক্ষপাতিত্ব জীবনকে অর্থবহ করে তুলত!

তাঁর ‘একা’ উপন্যাসটি মধ্যবিত্ত জীবনের অবক্ষয় এবং না পাওয়ার হাহাকারে জর্জরিত হয়ে থাকে। ঘর সংসার সমাজ কোনোকিছু যে মানুষকে পূর্ণতা দিতে পারে না, মানুষ যে অধরার পেছনে মধ্যবয়সেও ছুটে চলে তারই এক অবক্ষয়িত বর্ণনা এই বইয়ের পাতায় পাতায়। মানুষের চাওয়া ও স্বপ্নেরও নেই কোনো ইতি, মানুষের মনের দেওলেপনারও নেই কোনো সুরাহা, মানুষ মূলত যে একাই , সবকিছু পাওয়ার পরেও যে মানুষের জীবনের সান্ত¡না মেলে না , এই উপন্যাসটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।  সামাজিক বাধা বিপত্তি এবং মধ্যবিত্তের স্বাভাবিক সংযমের আড়ালেও চিৎকার করে কেউ যেন বলতে থাকে, না , আমরা সুখী না। কারণ সুখী হওয়ার জন্য আমরা এ পৃথিবীতে আসিনি!

মানুষ স্বপ্ন দেখা মানুষ কোনোদিন সুখী হতে পারে না! কারণ ক্রমাগত স্বপ্নের রঙ পাল্টে পাল্টে যায়। আর সেজন্যই যেন তিনি চিৎকার করে রিকশায় বসে বলতে চান, ‘‘ না, আপনি নামবেন না, কিছুতেই না। আমি আপনাকে নামতে দেবো না। কোনেদিন না।’’ কিন্তু যে নামবার সে নেমেই চলে যায়। আর কোনোদিন ফিরে আসেনা। জীবনের মানে যেন শুধু হাতছানি দেওয়া হয়ে যায় চোখের নিমেষে। জীবন বড় বাস্তব হয়ে যায়। হাহাকার ভরে দেয় জীবনের বাতাস। বস্তুত পক্ষে মানুষের জীবনই যেন জীবনের শেষে হাহাকার হয়ে যায়।

না, তাঁর লেখার ভেতরে কোনো পরাবাস্তবতা বা জাদু বাস্তবতা সেভাবে আসেনি। বোধের ভেতরে বোধ হয়ত আসেনি, সেগুলো হয়ত আসবে আরও পরে , জীবনের অভিজ্ঞতা আরও গাঢ় হওয়ার পরে।  তাছাড়া লেখাগুলোর ভেতরে কিছু তাড়াহুড়োর ছাপও বিদ্যমান, ভাষাও হয়ত সবসময় সেভাবে গোছালো নয়, তারপরও বলব এই লেখকের দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে, কারণ আমার ধারণায় নূর কামরুন নাহার সাহিত্যের সংগ্রামী পথ ধীরে ধীরে অতিক্রম করতে পারবেন তাঁর অধ্যবসায় এবং পর্যবেক্ষণ শক্তির ক্ষমতা দিয়ে। আমি তাঁর সাফল্য কামনা করি। এবং আশার দৃষ্টিতে সেইদিনের অপেক্ষায় থাকি।

জয় হোক নূর কামরুন নাহার। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা 

ইত্তেফাক/এমএএম