শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্রগাঢ় বাংলা-বন্ধুর প্রস্থান

আপডেট : ২৯ মে ২০২১, ০৪:৩২

চারদিকে মৃত্যু, মৃত্যুভয়, উদগ্র সংক্রমণ, সংক্রমণের প্রাক্-আতঙ্কে আমাদের অনেকেই দিগ্ভ্রান্ত, বিহ্বল হয়ে আছি। আর এসব ভেদহীন, বেপরোয়া ঘটনা যদি দেবেশ রায়, আনিসুজ্জামান, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, হোমেন বরগোহাঙ্গির মতো প্রজ্ঞা, বিবেক, ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক দ্রষ্টাদের অনুষ্ঠিত, স্থাপিত আসনকে হঠাত্ শূন্য করে দেয়, তখন—হ্যাঁ তখনই ডাকাতিয়া মৃত্যুর নিনাদিত, আরোপিত বেদনা বুকে বড্ড বেশি বাজতে থাকে। খাজা আহমেদ আব্বাসের আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড’-এর মর্মোচ্চারিত অভিজ্ঞতার দিকেও ফিরে তাকাতে হয়, প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে তাড়া করে, ভাবিয়ে তোলে, চাপিয়ে দেয় অজেয় দুঃখ—কেননা আমি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নই।

আধুনিক ভারতের আরেক উত্তমতম, মহোত্তম সাংবাদিক ও লেখক হোমেন বরগোহাঞি-র এই উচ্চারণ, আশা করি, এই দুঃসময়ে, অতিমারির ঘন ঘন হামলার মুহূর্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের বিস্তৃত বিকল্পকে আরো বেশি দৃষ্টিগোচর করে তুলবে। হোমেন বরগোহাঞি (জন্ম ১৯৩২, মৃত্যু ১২ মে ২০২১ ) অন্তত ১০০ বছর বাঁচবেন এই আশা ছিল। ঝকঝকে, প্রাণচঞ্চল, সংযমী, যৌবনমুখর মনীষা। নিজেও বিশ্বাস করতেন, স্বাস্থ্যময়, সংবেদশীল আর সজীব ও সবুজ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সক্ষম সঞ্চালন নিয়ে জেগে থাকবেন। কিন্তু চারপাশে অকালমৃত্যুর বিস্তার দেখে, মৃত্যুভয় অতিক্রম করে তাকে বলতে শোনা গেল, জীবনের সব স্বাদই পরিপূর্ণ, যাবার ভয় কীসের? চলে যাব। কিন্তু এ স্বস্তি, স্বঅর্জিত তৃপ্তি কাটিয়ে উঠলেন অচিরে। কোভিদকে হারিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই তার একজন গুণমুগ্ধ সমাজকর্মীর মেসেজের জবাবে প্রগাঢ় অনুভূতি ছড়িয়ে জানালেন, যাব না, যেতে ইচ্ছা করছে না, আমাকে ঘিরে বহুজনের উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা দেখে বুঝতে পারছি, জীবন ছেড়ে প্রস্থান সম্ভব নয়। শতবর্ষ থেকে ১১ বছর দূরে বিরাজ করছিলেন অসমিয়া ভাষার সেরা সাংবাদিক ও প্রাজ্ঞ লেখক। লিখতেন অসমিয়া, বাংলা ও ইংরাজিতে। বহুভাষিকতা আর বহুত্ববাদিতা তার স্বভাবধর্ম। এ কারণে একভাষিক সংকীর্ণতাকে ঘা দিয়ে বাংলায় লিখতেন, জাতিবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষকে কশাঘাত করে এককতার মহিমার উপাসনা করতেন। কোভিদ হূদ্যন্ত্রের গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, এ ক্ষত ছিনিয়ে নিল আধুনিকতাবোধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও সমাজের নিখুঁত ভাষ্যকারকে।

সংবাদপত্রের সম্পাদনা আর সাংবাদিকতায় তার আসন কোথায়? উচ্চে, অতিশয় উচ্চে। যেখানে বোধ, মুনশিয়ানা, বিশ্লেষণ, উদ্ভাবনা ও অনুসন্ধান ছুঁয়ে আছে তার ব্যক্তিপ্রতিভাকে। আবার এ ব্যক্তিকতা এতটাই আত্মসচেতন এতটাই সমাজনিষ্ঠ যে, ব্যক্তির বাইরের আবরণ ভেতরের ‘আমি’র দাবি ও আবেদনের কাছে অবনত হয়ে থাকত। এই ধাত্রূধারণের মাধ্যমে, তার সক্ষম অনুগামীদের আমৃত্যু ঋদ্ধ করে গেলেন হোমেন। আলবেয়ার কামু, জাফল সার্তের মতো মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার পাঠে গড়ে উঠেছিল যে মনন, তার পক্ষে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে দূরে সরে থাকা কি সম্ভব ছিল? মনে হয় না। স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন অন্বেষণ, স্বাধীন বিবেকের দূর ও নিকটদর্শন অভীষ্ট ছিল হোমেন বরগোহাঞির। এ লক্ষ্য অর্জন অপূর্ণ থাকেনি। ভরে উঠেছিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খানিকটা হলেও পূর্ণ করেছে তার গুণমুগ্ধ তরুণদেরও।

ষাট বছর জুড়ে সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ কর্মী, কখনো সাপ্তাহিক, দৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা, কখনো নির্ভীক ভাষ্যকার—এভাবে কর্ম আর খ্যাতির বিস্ময়কর শীর্ষারোহণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সাংবাদিকতা কতটা দুঃসাহসী, কতটা গড্ডলিকাবিরোধী, দ্রোহী হতে পারে—তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে হোমেনের প্রতিটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। জীবনের শুরুতে স্কুল শিক্ষক, তারপর এসডিসির চাকরিযোগ, চাকরি করতে করতে ছদ্মনামে ‘বিভিন্ন নরক’-দেখা আর অকপট লেখার জন্য সরকারের কোপদৃষ্টির নিক্ষেপে চাকরিতে ইস্তফা, এবং সর্বক্ষণের লেখক ও সাংবাদিকের দিনযাপন বেছে নেওয়ার ঝুঁকি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। পঞ্চাশের দশকে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা, ষাটের দশকে বাঙাল খেদাও, সত্তরের দশকে নকশাল দমনের নামে যুবহত্যা, ছাত্রহত্যা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নহীন সমর্থন, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একভাষিক আধিপত্যবাদকে কেন্দ্র করে জাতিবিদ্বেষের সংক্রমণও ভাষিক সংখ্যালঘুর গৃহে গৃহে অগ্নিসংযোগ, ’৬৯ থেকে ’৮৫ সাল পর্যন্ত বিদেশি খেদাও আন্দোলনের মুহূর্তে গণহত্যা—এরকম আত্মঘাতী কোনো মুহূর্তেই গা বাঁচানোর বুদ্ধিজীবীদের সতর্ক নৈঃশব্দ, উদাসীনতা অথবা পক্ষপাতিত্বকে রেহাই দেননি। কলম তার অনর্গল অগ্নিবর্ষণ করে গেছে। বলেছে, খেসারত দিতে হবে রাষ্ট্রচালিত, অনুশাসিত সমাজকে। অতন্ত স্পষ্ট ভাষায় বারবার বলে গেছেন, অসমিয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া বিভ্রান্ত, স্তম্ভিত হয়ে যাবে। নির্ভুল পর্যবেক্ষণ যা আজ পারস্পরিক অবিশ্বাসের নির্মম বাস্তব।

বিস্ময়কর সাহিত্যকর্মে, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও মননশীল প্রবন্ধেও অকপট ও সংযত তার ভূমিকা। একই সঙ্গে সরব, বুদ্ধিদীপ্ত সাংবাদিকতা আর বিবেকময় লেখকতার বিস্তার সচরাচর দেখা যায় না। তার কোন সত্তাটি বড়? লেখকের, না সাংবাদিকের? দুটোই। একটি আরেকটির পরিপূরক এবং সমধর্মী এবং গতানুগতিক স্রোত থেকে অনেক দূরে। এই দূরত্বকে নৈকট্যে রূপান্তরিত করেছিল তার ঐতিহ্যপ্রীতি, লোকপ্রেম আর নিরূপম বহুত্ববাদিতা। ১২টি উপন্যাসের স্রষ্টা, অসংখ্য গল্পের জনক (প্রকাশিত পাঁচট সংকলন), ৯ প্রবন্ধ গ্রন্থ, আত্মজীবনীমূলক চারটি বই উপহার দিয়েছেন আমাদের এবং বিনম্র, সংযত সজল উচ্চারণে জানিয়ে গেছেন, আমার হূদয় একটি যুদ্ধক্ষেত্র, যে যুদ্ধে পরাজয় নেই, নেই জয়ের গৌরববোধ। অনুভব আব নৈব্যক্তিক নিরীক্ষণে ভাস্বর তার প্রতীতি। দৈহিক মৃত্যুতে ভয় ছিল না, বাস্তবতাকে মেনে নিতে জানতেন, কিন্তু দেহাবসানের পরেও যে চেতনা, যে মগ্নতা ছড়িয়ে থাকে, সে বিশ্বাস জাগিয়ে রাখতেন, সাংবাদিকতা আর লেখকসত্তার বিস্তৃতিতে। এরকম বিশ্বাসে কি ভুল আছে কোথাও? আমার সৌভাগ্য, ৫০ বছর ধরে তার অকাতর স্নেহ, তার অবাধ প্রশ্রয় পেয়েছি। আমি ভাগ্যবান, আজকালে প্রায় দেড় দশক তার সঙ্গে কাজ করেছি, তার নিয়মিত পূর্বাঞ্চলীয় কলমে ক্ষোভ দেখে বিস্মিত হয়েছি, তত্সাহসে সঞ্চারিত বোধ করেছি। আলফার সন্ত্রাসের মোকাবিলায় তার সদর্থক অবস্থান, এনআরসি আর নাগরিকত্ব আইনকে ঘিরে আমাদের দ্বিচারিতা নিয়ে একজন লেখক, একজন চিত্তজয়ী সম্পাদক কত গভীর মনোবিশ্লেষক হতে পারেন, তার বেনজির নজির হয়ে থাকবেন হোমেনদা। বিশ্বনাগরিক হোমেন বরগোহাঞি।

লেখক :ভারতীয় সাংবাদিক; সম্পাদক, আরম্ভ পত্রিকা

ইত্তেফাক/ইউবি