শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সাহিত্য-সমালোচনায় মান্নান সৈয়দের পাণ্ডিত্য

আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১৯

বিশশতকের ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের (১৯৪৩-২০১০) আবির্ভাব। কবিতার বিষয় ও প্রকরণে অভিনবত্বের গুণে তাঁর প্রাতিস্বিকতা স্বীকৃত। কবি হিসেবে দ্যুতিময় পরিচয় ছাড়াও তিনি শিল্পের বিচিত্রপথের অনুসন্ধানী শিল্পী। 

ত্রিশের দশকের কবি বুদ্ধদেব বসুকে আমরা যেমনটি দেখেছি, আবদুল মান্নান সৈয়দও তেমনই কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকলা, আত্মজীবনী, শিশুসাহিত্য, সাহিত্য-সমালোচনা, গল্প-উপন্যাস ও সম্পাদনাসহ নানামাত্রিক কাজে নিবেদিত ছিলেন। এই বিবেচনায় তাঁকে ‘বহুমাত্রিক’ কিংবা ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। আবদুল মান্নান সৈয়দের শিল্পচেতনার উদ্ভাস ঘটেছে নানা আঙ্গিকে।

বিভিন্ন শ্রেণির সাহিত্যবৈভব পাঠান্তে শিল্পমূল্য যাচাইকল্পে তিনি কলম ধরেছেন। বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যের শিল্পমূল্য নির্ণয় করতে হলে একজন শিল্পীকে এই ধারার লেখায় অবতীর্ণ হওয়া জরুরি। মহিশল্পীর হাতেই কেবল উত্কৃষ্ট সমালোচনা-সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে। এটাও শিল্পীর জন্যে একধরনের দায়বদ্ধতা। 

কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটকের পাশাপাশি সাহিত্য-সমালোচনায় মান্নান সৈয়দ কেন উদ্যোগী হয়েছেন? এমন জিজ্ঞাসার জবাব তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক—‘কেন সমালোচনা? সমালোচনা কি প্রয়োজনীয়? হ্যাঁ, সমালোচনা শুধু প্রয়োজনীয় নয়, আবশ্যিক। কেননা সৃষ্টিকে যদি একটি নদীর সঙ্গে তুলনা করা যায়, সমালোচনা তার পাড়। পাড় ছাড়া নদীর ধারণাই সম্ভব না। সমালোচনা সৃজনকাজকে অন্তঃশীল গতি দ্যায়, রূপরেখা দ্যায়, অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমানের শিল্পকলাকে মেলায়। বর্তমান অর্থহীন, যদি তার পেছনে না থাকে অতীতের ধারাবাহিকতা, না থাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। সমালোচনা সাহিত্যের একটি পরিমাপক।’ (সমালোচনা/ বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা)।

আব্দুল মান্নান সৈয়দের সকল প্রশংসা তাঁর

ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্য-সমালোচনার এমন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মান্নান সৈয়দ অসংখ্য প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গদ্য লিখেছেন। সেসব লেখা সমকাল তো বটে, এখনো শিল্পের তুল্যমূল্য যাচাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান লেখায় সাহিত্য-সমালোচক-গবেষক-প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দের শৈল্পিক সুচিন্তা ও মনোভঙ্গি সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস থাকবে।

২.

মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবনে এসে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে সৃজনশীল কবিমানসের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নের সম্মিলনের ব্যাপারটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মননে সাহিত্যের সমালোচনা কিংবা গবেষণার ক্ষেত্রে এভাবেই তৈরি হয়েছে উর্বর বীজতলা। 

লেখালেখির উন্মেষপর্বে তিনি নিজের শিল্পসত্তাকে শাণিত করার অভিপ্রায় নিয়ে ডুবে ছিলেন দেশ-বিদেশের ধ্রুপদী সাহিত্যের সরোবরে। তাঁর ভাষায়—‘আমার একটি লেটো পিরিয়ড আছে। নজরুলের মতো। ... লেটো পিরিয়ড আমি বলছি, নজরুলের অর্থে বলছি, সব লেখকের একটা এরকম পিরিয়ড থাকে, মাইকেলের ছিলো, ইংরেজি কবিতা লেখার সময়টা, আমার এই লেটো পিরিয়ডটা আমার এম.এ পাশের পর। ওই পিরিয়ডে আমি নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত, সংস্কৃত করার চেষ্টা করেছি।’ (সাক্ষাত্কার : শিমুল সালাহ্উদ্দিন)।

মান্নান সৈয়দ অ্যাকাডেমিক অভিসন্দর্ভ কিংবা তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাপত্র লিখেছেন। আবার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণনির্ভর সমালোচনাসাহিত্য রচনার মধ্যে দিয়ে বাংলা সমালোচনাসাহিত্যের ধারাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে সাহিত্যবিচারের অন্তর্কাঠামোকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তাঁর ‘বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা’, ‘দশ দিগন্তের দ্রষ্টা’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘করতলে মহাদেশ’, এবং ‘আমার বিশ্বাস’ শিরোনামের গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলো যার উজ্জ্বল উদাহরণ।

৩.

আবদুল মান্নান সৈয়দ মূলত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পরবর্তীকালের সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা লিখেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যের প্রভাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে বাঁকবদল, তিনি সাহিত্য-সমালোচনার ভেতর দিয়ে তার স্বরূপ উন্মোচনে আগ্রহী হয়েছেন। তাঁর এই সমালোচনাপ্রয়াসে একধরনের পরম্পরা লক্ষণীয়। যেমন—ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-লালন ফকির-মাইকেল মধুসূদন দত্ত-গোবিন্দচন্দ্র দাশ-কায়কোবাদ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-মোহিতলাল মজুমদার-কাজী নজরুল ইসলাম-জীবনানন্দ দাশ-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে-সমর সেন-সুকান্ত ভট্টাচার্য-জসীমউদ্দীন-ফর্রুখ আহমদ-আবুল হোসেন-সিকানদার আবু জাফর-শামসুর রাহমান-হাসান হাফিজুর রহমান-রফিক আজাদ এবং আবিদ আজাদ হয়ে আলোচনার প্রবাহ আরো বহুদূর অগ্রসরমান ছিল। 

ধারাবাহিকভাবে এমন সাহিত্য-সমালোচনার রেওয়াজ সমকালে তেমন চোখে পড়ে না। এটা কেবল একজন একনিষ্ঠ পরিশ্রমী শিল্পসমালোচকের পক্ষেই সম্ভব। কবিতার সমালোচনা লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি। কথাসাহিত্য নিয়েও বিস্তর লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবার লেখা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। জগদীশ গুপ্তর ‘প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘উজানে মৃত্যু’, আবু রুশদ, শওকত ওসমান এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘কতিপয় প্রবন্ধ’ গ্রন্থ-সহ উত্তরপ্রজন্মের আরো অনেকের সাহিত্য-সমালোচনা করেছেন।

ছবি: সংগৃহীত

মান্নান সৈয়দ অভিনিবেশনির্ভর গবেষক। একই সমান্তরালে ব্যক্তিগত বোধের নিরিখে বিশ্লেষণপ্রয়াসী মনোযোগী পাঠক। বাংলা ভাষার শক্তিমান কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে লেখা অসংখ্য প্রবন্ধে তার প্রমাণ স্পষ্ট। কবিতা-সমালোচনার ক্ষেত্রে বিষয় ও আঙ্গিকগত পরিচর্যাকে মান্য করে তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিশ্লেষণ করেছেন। জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিসত্তার সন্ধানে প্রবন্ধ-গবেষণামূলক লেখা ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সঙ্গে পত্রবিনিময় করেছেন। অপ্রকাশিত লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি এ ধরনের মননশীল কাজে দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন বলেই দীর্ঘসময় ব্যয় করে শ্রমসাধ্য গবেষণার কাজেও ক্লান্তিহীন ছিলেন। 

প্রসঙ্গক্রমে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে লেখা মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ-সংকলন ও সম্পাদিত পত্রিকাগুলো দেখে নিতে পারি। ‘শুদ্ধতম কবি’ (১৯৭২), ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতা’ (১৯৭৪), ‘সমালোচনা সমগ্র : জীবনানন্দ দাশ’ (সম্পাদিত, ১৯৮৩,), ‘জীবনানন্দ’ (১৯৮৪), ‘জীবনানন্দ-১’ (সম্পাদিত পত্রিকা, ১৯৮৪), ‘জীবনানন্দ-২’ (সম্পাদিত পত্রিকা, ১৯৮৫), ‘কিছুধ্বনি’ (জীবনানন্দ সংখ্যা, ১৯৯৩), ‘সমগ্র কবিতা : জীবনানন্দ দাশ’ (সংকলিত ও সম্পাদিত, ১৯৯৩), ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (সম্পাদিত, ১৯৮৬), ‘জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলি’ (সংকলন ও সম্পাদনা, ১৯৮৭), ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (সম্পাদিত, ১৯৮৯), ‘প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র : জীবনানন্দ দাশ’ (সম্পাদিত, ১৯৯৪) এবং ‘রূপসী বাংলা : জীবনানন্দ দাশ’ (সম্পাদিত, ১৯৯৬)।

জীবনান্দের মতো নজরুলের কবিতা নিয়েও মান্নান সৈয়দ ব্যাপকভাবে গবেষণা করেছেন। কবিতা নিয়ে একাধিক সমালোচনাগ্রন্থ রচনা করেছেন। যেখানে নজরুলের কবিতার সারবত্তা এবং ব্যক্তি কবির চেতনালোক উন্মোচিত হয়েছে। নজরুল-সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণাগ্রন্থগুলো যথাক্রমে—‘নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা’ (১৯৭৭), ‘নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর’ (১৯৮৭) এবং ‘নজরুল ইসলামের কবিতা’ (২০০৩)। এছাড়া নজরুল বিষয়ক বেশকিছু গ্রন্থ তাঁর সুসম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।

মান্নান সৈয়দের কাজের পরিধি ব্যাপক ও বিচিত্র। বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে তিনি আটজন বরেণ্য ব্যক্তির জীবনীগ্রন্থ রচনা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিচিত্র বিষয়ে লেখা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে। যেমন : ‘কবি ও কবিতা’ (১৯৭৭), ‘ছন্দ’ (১৯৮৫), ‘চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে’ (১৯৮৯), ‘পুনর্বিবেচনা’ (১৯৯০), ‘দরোজার পর দরোজা’ (১৯৯১), ‘রবীন্দ্রনাথ’ (২০০১), ‘ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী’ (২০০৭) এবং ‘বিংশ শতাব্দীর শিল্প আন্দোলন’ (২০০৮)।

ছবি: সংগৃহীত

শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করে যে ক’জন বরেণ্য লেখক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়েছেন, মান্নান সৈয়দ তাঁদের অন্যতম। তিনি যুগপত্ সৃজনশীল ও মননশীল শিল্পধারায় আমৃত্যু সাধনা করেছেন। সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে নির্মোহ ও যুক্তিশীল মনোভঙ্গি পোষণ করতেন। ফলে তথ্য ও তত্ত্বের বিশ্লেষণপূর্বক উদ্দিষ্ট বক্তব্যকে পাঠকের সামনে সহজেই হাজির করতে পারতেন। 

তাঁর সাহিত্য-সমালোচনার ভাষা যুগপত্ ওজস্বীপূর্ণ ও সাবলীল। সমালোচনার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সমালোচনারীতির প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল। সাহিত্যবিশ্লেষণে নিজস্ব যুক্তি ও মতামত প্রদানের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আলোচনা শেষে পাঠকের মনে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো অনুভূতি সঞ্চার করতেন। এটাই একজন শক্তিমান সাহিত্য-গবেষকের সার্থকতা। 

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি’র [দ্বিতীয় খণ্ড] ভূমিকায় সম্পাদক অনু হোসেন যথার্থই বলেছেন-‘মান্নান সৈয়দ শেষ পর্যন্ত প্রবন্ধ ও সমালোচনাকে একটি মিলিত ধারার মধ্যে দেখতে চেয়েছেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ সমালোচনা, গবেষণা কিংবা প্রবন্ধ রচনার কাজগুলোতে সারফেসকেন্দ্রিক বা ওপরতলের অনুসন্ধানই অতিমাত্রায় লক্ষ করা যায়। 

প্রকৃত কাঠামোভিত্তিক সমালোচনা বা গবেষণার কাজ খুব বেশি নজরে আসে না। ভালো সমালোচনার কাজ করতে হলে ইনার স্ট্রাকচারে প্রবেশ করা জরুরি। কিন্তু এই কাজ সম্পাদনে অনেকেরই সে পরিমাণ শ্রমাসক্তি ও নিষ্ঠা জাগ্রত হয় না। মান্নান সৈয়দের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী।’

ইত্তেফাক/এএএম