জীবনের সংগ্রামে হার না মানা যুবক মুসনাদ ই আহমেদ। বাবার হার্ট স্ট্রোকের কারণে অর্থাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বন্ধ হলেও যিনি থেমে থাকেননি। কোচিং এ ক্লাস নিয়ে, প্রাইভেট টিউশন করিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইংরেজিতে কথা বলার (ইংলিশ স্পোকেন) দক্ষতা অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালে একটি কল সেন্টারে এজেন্ট হিসেবে চাকরীর মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু হলেও ২০১৩ সালে তার উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরমাঝে তিনি দিনে চাকরি করে অবস্থাতেই রাতে বাসায় ফিরে অনলাইনে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে কাজ করে শুরু করেন। রাত জেগে কাজ করতে করতে একসময় ৫ জন কর্মী নিয়ে শুরু করলেন নিজের প্রতিষ্ঠান। স্বপ্ন যাকে ঘুমাতে দেয়নি, সেই মুসনাদ আজ বাংলাদেশ বসেই বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেলি-মার্কেটিং সেবা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বছরে ১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করছেন। এছাড়াও প্রায় আড়াইশো তরুণের কর্মসংস্থান করেছে তিনি।
সম্প্রতি ইত্তেফাক অনলাইনকে কল সেন্টার এজেন্ট থেকে আন্তর্জাতিক কল সেন্টার প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার পেছনের গল্প জানিয়েছেন স্কাই টেকের প্রতিষ্ঠাতা মুসনাদ ই আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইত্তেফাক অনলাইনের প্রযুক্তি প্রতিবেদক আর. কে. জ্যান।
ইত্তেফাক অনলাইন: আপনার ক্যারিয়ারের শুরুটা সম্পর্কে জানতে চাই?
মুসনাদ ই আহমদ: আমার ক্যারিয়ারের শুরুটা হয় ২০০৮ সালে, তখন বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি আন্তর্জাতিক কল সেন্টার চালু হয়। এইচএমসি টেকনোলজিতে নামে একটি আন্তর্জাতিক কল সেন্টারে আমি এজেন্ট হিসেবে চাকরি নেই। তারপর ২০০৯ সালে লিগ্যাটো সার্ভিসেস নামে আরেকটি কল সেন্টার কোম্পানিতে এজেন্ট পদে যোগদান করি। এরপর ২০১০ সালে আমি দুই দফায় পদোন্নতি পেয়ে অপারেশন সুপারভাইজার হয়ে যাই। আর এখান থেকেই আমি আসলে আন্তর্জাতিক কল সেন্টার পরিচালনার সকল কৌশল রপ্ত করি। এরপর আমি ২০১১ সালের শেষে লিগ্যাটো চাকরি ছেড়ে কোয়ালিটি অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগ দেই ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেডে। আর ২০১২ সালে আমি আমার জীবনের শেষ চাকরিতে এডিসন গ্রুপের মোবাইল ব্র্যান্ড সিম্ফনির কল সেন্টার কোঅর্ডিনেটর পদে যোগ দেই।
ইত্তেফাক অনলাইন: শেষ চাকরি কেন ?
মুসনাদ ই আহমদ : শেষ চাকরি কারণ, এরপর আমি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করলাম। সিম্ফনিতে চাকরি করা অবস্থাতেই আমি চিন্তা করি যে আমার নিজের কিছু করতে হবে। এই চিন্তাটাই আসলে আমাকে ঘুমাতে দেয়নাই। একটা সময় আমি দিনের অফিস শেষ করে রাতে বাসায় এসে আমার কম্পিউটারে বসে ওডেস্ক (বর্তমান আপওয়ার্ক), ইল্যান্স, ফ্রিল্যান্সার ডটকমে আমার সংশ্লিষ্ট কাজের বিষয়ে নিজের প্রোফাইল খুলে কাজের সন্ধান করতে থাকি। এরমধ্যে আমি একদিন ৩ ডলার প্রতি ঘন্টার একটি টেলিমার্কেটিং লিড জেনারেশনের কাজও পেয়ে যাই। সেখান থেকেই আমার এই বিপিও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বুনন শুরু।
ইত্তেফাক অনলাইন: নিজের কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করলেন কিভাবে ?
মুসনাদ ই আহমদ : ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ চলাকালীন সময়ে আমার গ্রাহক তালিকা বাড়তে থাকলো। আমেরিকা, কানাডার বিভিন্ন ক্লাইন্টের কাজের পরিমান এত বেড়ে গেলো যে তারাই আমাকে টিম বড় করার তাগিদ দিতে থাকে। সেই সুবাদে প্রথমে আমি আমার বাসাতেই আমার পরিচিত দুই ছোট ভাইকে যুক্ত করি। টিম বড় হয়, কাজের পরিমান আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু কাজ যেই পরিমাণে বাড়ছে, সেই পরিমান কর্মী আমি নিয়োগ করতে পারছিলাম না। কারণ, আমার হাতে অফিস সেটআপের মত বিনিয়োগের টাকা ছিল না। তবে ২০১৩ সালে আমি চাকরির সুবাদে, ৩ লক্ষ টাকা ব্যাংক লোন নেই। সেই টাকায় ৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্কাইটেক সলিউশনস। আর সেই ৫ জন কর্মী সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে আমার কর্মস্থলে ৪টি ফ্লোরে আড়াই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন।
ইত্তেফাক অনলাইন: কোন কোন দেশে, কি কি সেবা নিয়ে কাজ করছেন?
মুসনাদ ই আহমদ : আমরা মূলত আমেরিকা (ইউএসএ), অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাতে কাজ করি। যার মধ্যে বেশিরভাগ গ্রাহকই আমাদের ইউএসএ এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে। এছাড়াও কানাডাতেও আমাদের বেশ কিছু গ্রাহক আছে। এদের মধ্যে আমরা আমেরিকার কিছু লোনদাতা, লজিস্টিকস ও লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির পক্ষে টেলিমার্কেটিং করি যেখানে আমাদের বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) এবং বিজনেস টু কাস্টমার (বিটুসি) প্রসেস নিয়ে কাজ করতে হয়। এছাড়াও আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশটির ৩০টি স্টেটের প্রায় ৫০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তাদের গ্রাহক খুঁজে দিতে সাহায্য করে। এছাড়াও আমরা ইউএসএ'র বেশ কিছু ই-কমার্স এবং ফুড ডেলিভারি কোম্পানির ভয়েস কাস্টমার সাপোর্ট, চ্যাট সাপোর্ট এবং ইমেইল সাপোর্ট প্রদান করে থাকি। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়াতে আমরা সোলার অ্যাপয়েনমেন্ট সেটিং এবং দেশটির সরকারের এনার্জি সেভিং প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে টেলিমার্কেটিং সেবার মাধ্যমে অ্যাপয়েনমেন্ট সেট করি। আর কানাডার একটি গ্রাহকের হয়ে ইউএসএ, ইউকে এবং কানাডাতে আমরা গুগল ম্যাপ এসইও সাপোর্ট সহ দেশগুলোর লোকাল কোম্পানির লিড জেনারেশন, ব্যাক অফিস সাপোর্ট এবং কাস্টমার সাপোর্ট প্রদান করি।
ইত্তেফাক অনলাইন: বাৎসরিক কেমন আয় হয় আপনাদের ?
মুসনাদ ই আহমদ : আমাদের কোম্পানী স্কাই টেক সলিউশনস এ বর্তমানে আড়াইশোরও বেশি কর্মী কাজ করছে। এতে করে এখান থেকে আমাদের যে আয় হয় তা হিসেব করলে গড়ে আমাদের বাৎসরিক আয় দাঁড়াবে ১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
ইত্তেফাক অনলাইন: নিয়োগের ক্ষেত্রে কি কি কোন যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেন এবং বেতন কেমন হয়?
মুসনাদ ই আহমদ : আমাদের এখানে গ্রাজুয়েশন থাকাটা জরুরী নয়। কারণ, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কেউ আসলেও এখানে চাকরী করা সম্ভব। কারণ, আমরা নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট না প্রার্থীর ইংরেজি বলার ধরন আর যোগাযোগ দক্ষতা, এবং কম্পিউটার পরিচালনা দক্ষতাকে প্রাধান্য দেই। পরবর্তীতে যারা মোটামুটি দক্ষ, নির্বাচিত সেই ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর তাদেরকে আন্তর্জাতিক বাজার, মুদ্রা, কথা বলার ধরণসহ বৈদেশিক সংস্কৃতি, যোগাযোগ পদ্ধতি এবং আমাদের কর্ম প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদেরকে ২০ দিনের একটি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অন জব ট্রেনিং এ নিয়ে যাই। এভাবে একজন পরিপক্ব এজেন্ট তৈরি করতে আমাদের প্রায় ৩ মাস লেগে যায় এবং এই পুরো সময়টাই তারা আমাদের থেকে বেতনও পায়। আমাদের এখানে কাজের সময় হলো ৮ ঘন্টা আর একদম ফ্রেশারের ক্ষেত্রে বেতন শুরু হয় মাসিক ১৪ হাজার টাকা। বেতন হয় মূলত ঘন্টা নির্ভর, যা ৭০ টাকা থেকে শুরু ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এরমানে অভিজ্ঞ হলে এখান থেকে ৭০ হাজারেরও বেশি আয় করা সম্ভব। আমরা আমাদের কর্মীদের ফ্রি লাঞ্চ এবং ডিনার প্রদান করি। পাশাপাশি কর্মীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারী বিধি মোতাবেক বোনাস ছাড়াও আমরা কোম্পানির পক্ষ থেকে একটা ইয়ার এন্ড বোনাস দিয়ে থাকি।
ইত্তেফাক অনলাইন: এই খাতের চ্যালেঞ্জগুলো কি কি?
মুসনাদ ই আহমদ : এই সেক্টরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পেমেন্ট গেটওয়ে ইস্যু। এরপরেই আছে মানবসম্পদ তৈরি করা, সংশ্লিষ্ট সরকারী নানা দপ্তরে যেসব কার্যক্রম আছে, সেগুলোকে আরও তরান্বিত করা। যেমন, আইপি চেঞ্জ করা, ব্যান্ডউইথ বাড়ানো, কল সেন্টার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সময় প্রয়োজন হয়। এছাড়াও আমাদের মত রেজিস্টার্ড কল সেন্টারগুলোর জন্য ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) বা ভয়েস ব্যান্ডউইথ লিমিট তুলে দেওয়া প্রয়োজন। আর যদি এই সেবাকে রেস্ট্রিকশনের মধ্যে রাখেই তাহলে অনুমোদনের সময় ও যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সময়টাকে কমিয়ে আনতে হবে। এইগুলোই এখন আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ মনে হয়।
ইত্তেফাক অনলাইন: এই খাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি?
মুসনাদ ই আহমদ: এইখাতে আমাদের দেশে বর্তমানে বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশকে তিনি বিপিও হাব হিসেবে বিশ্বের অন্যতম একটি স্থানে দেখতে চান। এখন একটু আগে যেই চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বললাম এইগুলোর পাশাপাশি সরকার যদি আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের এই বিপিওখাতকে তুলে ধরতে পারে তাহলেই আমরা সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারবো। আর ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু এই বিপিও খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে বলে আশা রাখি। তখন আর শুধু গার্মেন্টস নির্ভর নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিখাতেও শীর্ষ সেবাদানকারী দেশ হিসেবে চিনতে পারবে।
ইত্তেফাক অনলাইন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
মুসনাদ ই আহমদ: আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এখন আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মার্কেটের পাশাপাশি আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান করা। আমরা দেশের বাজারে আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম চলছে। একই ভবনে আমাদের আরও দুটি ফ্লোর বাড়ছে। যার মানে আগামী ২০২২ সালে আমাদের বাৎসরিক আয় ২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি হবে বলে আমি আশাবাদী।
ইত্তেফাক/আরকে