শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ

আপডেট : ১৬ মে ২০১৯, ০৩:৪৩

আইসিটি শিল্পে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই সংগঠনটি হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট সার্ভিস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্সসহ দেশের সকল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি সমাজ ও দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট খাতে আমদানি-রপ্তানিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে বিসিএস-এর নব-নির্বাচিত সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীরের কথা হয়। এতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটির সফলতা, বর্তমান কর্মকাণ্ড ও আগামী পরিকল্পনাগুলো। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন মাহবুব শরীফ

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম সফল একটি সংগঠন। সংগঠনটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছিল মো. শাহিদ-উল-মুনীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পহেলা এপ্রিল আমি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এর আগেও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতিতে ৪ মেয়াদে মহাসচিব, কোষাধ্যক্ষ, পরিচালক (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) পদে দায়িত্ব পালন করেছি। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ৪ মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সঙ্গে তিন মেয়াদে কাজ করার।’

২০০৯ সালে জব্বার ভাইয়ের নেতৃত্বে তিনদিনব্যাপী ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিট অনুষ্ঠিত হয়। সামিটে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা রূপরেখা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ছিল। সেমিনারে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেই সামিটের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। নিজের কাজের অভিজ্ঞতা এভাবেই প্রকাশ করেন বিসিএস সভাপতি শাহিদ-উল-মুনীর।

সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যে কাজগুলো অবশিষ্ট ছিল এবং বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিসিএস সভাপতি হওয়ার আগে আমার পরিচয় আমি বিসিএস-এর পরিচালক। সে হিসেবে কার্যনির্বাহী কমিটিতে আগে থেকেই সক্রিয় ছিলাম। সভাপতির দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি কাযনির্বাহী কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি তার রুটিন ওয়ার্ক সম্পন্ন করেন। আগের মেয়াদে যে কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলো আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে ওগুলো চলমান রয়েছে। এর মধ্যে এমআরপি, ওয়ারেন্টি পলিসি, গ্রাহক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে গতিশীল ও ব্যবসা বান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা অন্যতম। এগুলো আগের মেয়াদেও চলমান ছিল এবং বর্তমান মেয়াদেও চলমান রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এমআরপি ওয়ারেন্টি পলিসি কার্যকর হওয়ার ফলে, ক্রেতারা পণ্য কিনে আর প্রতারিত হচ্ছেন না। এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য সারা দেশে ১৭টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ৩০টি অভিযোগ আমাদের হাতে পড়েছে যা সবগুলোই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। আবার অনেকে না বুঝে অনলাইন থেকে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সদস্য নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। আমরা ক্রেতাদের বিসিএস সদস্য প্রতিষ্ঠানদের থেকে আইটি পণ্য কেনার আহ্বান জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, বিসিএস সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনলে তারা প্রতারিত হবেন না। ক্রেতারা যদি পণ্য কিনে সন্তুষ্ট না হন, তাহলে তারা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কাস্টমার ডেস্কে অভিযোগ দিতে পারবেন। আমরা ক্রেতাদের সচেতন করতে শিগগিরই অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামের উদ্যোগ নিবো। বিসিএস সদস্য প্রতিষ্ঠানদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্যও পরিকল্পনা রয়েছে। এতে গ্রাহকরা সহজেই বিসিএস সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো শনাক্ত করতে পারবেন।’

বিগত মেয়াদগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ও সফলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহিদ-উল-মুনীর বলেন, ‘১৬ বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তিতে সারাদেশে জনসচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বিসিএস। দীর্ঘ সময় আমাদের এই প্রচেষ্টার সুফল বর্তমানে দেশের ভোক্তারা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এই কার্যক্রমগুলো আরো গতিশীল করা প্রয়োজন।’

দীর্ঘদিন ধরে আপনাদের অনেকগুলো কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এগুলো আরো গতিশীল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আপনি। এজন্য আপনাদের প্রস্তুতি কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে মুনীর বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের আড়াই হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। সারাদেশে ৮টি বিভাগে শক্তিশালী শাখা কমিটি রয়েছে। বিসিএস-এর উদ্যোগে যেকোনো প্রোগ্রাম সফল করার জন্য তারা সবসময় প্রস্তুত আছেন। যেকোনো কার্যক্রম সারাদেশে একসঙ্গে পরিচালনা করতে পারি। সরকারের সহযোগিতা পেলে সংশ্লিষ্ট যেকোনো কার্যক্রম সফলভাবে আমরা পরিচালনা করতে পারবো।’

তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ উত্পাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে। এই কার্যক্রমে সরকারের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি। বর্তমানে দেশে ২ কোটি কম্পিউটার ব্যবহারকারী রয়েছে এবং এই খাতে কাজ করছে লক্ষাধিক লোকবল।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়েই কাজ করে না। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একমাত্র ব্যবসায়িক সংগঠন হিসেবে বেস্ট রেসপনসিবল সংগঠন-এর স্বীকৃতি পায় বিসিএস।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যাসোসিও ও উইটসার সঙ্গে দেশের একমাত্র সদস্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। ২০১৮ সালে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সরকারি এবং বেসরকারি মিলে উইটসা এবং অ্যাসোসিওতে আন্তর্জাতিক ৯টি পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব লাভ করেছে বিসিএস।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)-এর আগামী কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহিদ-উল-মুনীর বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো দেশের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বেশি তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণদের প্রযুক্তি খাতে কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। চলমান রয়েছে এমআরপি পলিসি ও ওয়ারেন্টি পলিসির কার্যক্রম। এই কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে লাভজনক হিসেবে রূপ দান করাও আমাদের অন্যতম পরিকল্পনা। সারাদেশে বিসিএস সদস্যদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিকল্পনাও আমাদের হাতে রয়েছে। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে আমাদের প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনাও হাতে রয়েছে। এছাড়াও কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীদের একটি মুনাফা বান্ধব ব্যবসায়ী খাত উপহার দেওয়ার জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

তিনি আরো জানান, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা অতিক্রম করার জন্য দ্রুত সময়ে ব্লকচেইন, রোবটিক্স, আইওটি নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এছাড়াও ই-বর্জ্য নিয়ে আমাদের কাজ শুরু করা দরকার। প্রতিবছর কী পরিমাণ ই-বর্জ্য জমা হচ্ছে, সেজন্য পরিবেশ কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। ই-বর্জ্য নিয়ে টেলিকম কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কয়েকদফা আলোচনা হয়েছে ও চীনের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও জানান শাহিদ-উল-মুনীর।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র, শেখ রাসেল ল্যাব, ইনফো সরকার-৩-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রচুর হার্ডওয়্যার এবং নেটওয়ার্ক প্রকৌশলীর প্রয়োজন রয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এবং যুবকদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে হার্ডওয়্যার খাতকে গুরুত্ব দিয়ে এই খাতে দক্ষতা বাড়ানোর কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে বিসিএস-এর।

২০২১ সালে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব আইটি (ডব্লিউসিআইটি) কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে। এটিকে আইসিটির অলিম্পিকও বলা হয়ে থাকে। অনেকগুলো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ডব্লিউসিআইটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। সারা পৃথিবী থেকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আড়াই হাজার বিশেষজ্ঞ এ অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন। এতে করে যেমন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হবে ঠিক তেমনি বিদেশি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে বলেও জানান বিসিএস-এর নব-নির্বাচিত সভাপতি।

মো. শাহিদ-উল-মুনীর

সভাপতি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন