শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বীরের বেশে, নিজের দেশে

আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৫:০১

চারদিকে সমুদ্র তরঙ্গের মাঝে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তখন যুদ্ধের তত্পরতা। বাইরের গেটে প্রহরীরা হিমশিম খাচ্ছেন লোকেদের সামলাতে। ভেতর থেকে বাড়তি পুলিশ ডাকতে হয়েছে। লোকেরা স্রোতের মতো আসছেন মিছিল নিয়ে; হাতে ব্যানার, ফেস্টুন আর ছোটো ছোটো বাঘ।

ভেতরেও পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধের না। শত শত সাংবাদিক আর চিত্রগ্রাহককে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে লাইন ধরে ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু তাদের এক জায়গায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। তারা চাচ্ছেন যাত্রীদের আসার পথের আরো যত কাছে যাওয়া যায়। এ নিয়ে হুড়াহুড়ি, চিত্কার আর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।

এর মধ্যেই চকচকে চোখে, আটপৌরে পোশাকে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে নিজে থেকেই বলল, ‘বন্ধুদের নিতে এসেছি।’

ছেলেটির নাম মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী। বিশ্বকাপ দলে ছিলেন; অপরিহার্য সদস্য ছিলেন। কিন্তু ইনজুরি তাকে আগেভাগে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এমন দিনে শরীরের ব্যথা তাকে বাসায় আটকে রাখতে পারেনি। সব অগ্রাহ্য করে চলে এসেছেন বিমানবন্দরে। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ী দলে থাকতে না পারা, ওদের সঙ্গে উল্লাস করতে না পারার কষ্ট আছে না?

প্রশ্নটা শুনে মৃত্যুঞ্জয় হাসলেন, ‘কষ্ট আছে। কিন্তু আজ নিজেকে খেলোয়াড় মনে হচ্ছে না। দেশের সাধারণ একজন মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের বরণ করে নিতে এসেছি। এটাই সৌভাগ্য মনে হচ্ছে।’

হ্যাঁ, এই সৌভাগ্য হলো কাল বাংলাদেশের।

শুধু মৃত্যুঞ্জয় নন; বিমানবন্দর থেকে মিরপুর হোম অব ক্রিকেটে পৌঁছানোর দীর্ঘ পথের দুই ধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে, হাত নেড়ে বরণ করে নিলেন বিশ্বকাপজয়ী খুদে ক্রিকেটারদের।

কথা ছিল, বরণটা শুরু হবে বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের বহন করা বিমানকে ‘ওয়াটার স্যালুট’ জানিয়ে। কিন্তু সে পর্ব নানা কারণে হলো না। তার পরও বিমান থেকে নামার পরই শুরু হলো অভিনন্দন জানানোর পালা। বিমানবন্দরের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা; সবাই অভিনন্দিত করলেন খেলোয়াড়দের। এরপর প্রবল ভিড় ঠেলে তাদের নিয়ে আসা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এ ছাড়া বোর্ড পরিচালক মাহবুব আনাম, জালাল ইউনুস, আকরাম খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়দেরও দেখা মিলল। এক কালের যুব ক্রিকেটার দুর্জয় যেন আকবরকে বুকে জড়িয়ে নিজেদের না পাওয়া ব্যথাটা ভুলতে চাইলেন।

বিমানবন্দরেই প্রথম দফা মালা তুলে দেওয়া হলো ক্রিকেটারদের গলায়। এর মধ্যে ঢুকে পড়া কয়েক জন সমর্থক এবং বাঘের একটি মাস্কটরূপী সমর্থক ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিত্কারে প্রকম্পিত করে তুললেন টার্মিনাল। কোনোক্রমে খেলোয়াড়দের মালা দেওয়ার পরই অধিনায়ক আকবর আলীকে কমান্ডো স্টাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এরপর বাকি খেলোয়াড়দেরও একে একে নিরাপত্তা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।

কোনোক্রমে মাহমুদুল হাসান জয়ের কাছে পৌঁছানো গেল। ঈষত্ চেনামুখ দেখে একটু হাসলেন। তারপর প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমরা বিশ্বকাপ জিততেই গিয়েছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু ঢাকায় নামার পর থেকে সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’

অবিশ্বাস্য যাত্রাটা আসলে শুরু হলো বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর। আগে পেছনে পুলিশের গাড়ি এবং সঙ্গে কয়েক জন কর্মকর্তার গাড়িসহ বহর বের হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের প্রবেশপথে আসতে আসতেই বহরে যোগ হয়ে গেল শ খানেক মোটরসাইকেল; প্রায় সবার কোনো না কোনো ক্রিকেটগোষ্ঠীর টি-শার্ট পরা। এর সঙ্গে যোগ হলো কিছু ছাদ খোলা মাইক্রোবাস। তরুণরা দুই হাতে দোলাতে থাকলেন পতাকা, মোটরসাইকেলেও উড়ছে পতাকা। আর পুরো ব্যাপারটা শোভাযাত্রার রূপ পেল গোটা তিনেক ট্রাক যোগ হওয়ায়।

ট্রাকগুলোতে চলছে ব্যান্ডের বাজনা এবং উড়ছে পতাকা।

এই শোভাযাত্রা খেলোয়াড়সহ সবাইকে আপ্লুত করে ফেলল পথের দুই ধারের দৃশ্য। এই কয়েক কিলোমিটার পথের পুরোটা জায়গায় দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে লোকেরা জানালেন অভিনন্দন। আস্তে আস্তে মানুষের ভিড় ঠেলে শোভাযাত্রা পৌঁছাল মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে।

ভেতরে নানান আয়োজনের অপেক্ষা চলছে। আর তখনো ব্যান্ডের সুরে বাজছে—জয় বাংলা, বাংলার জয়।

ইত্তেফাক/বিএএফ