১৯৬০-এ শুরু আর ২০২০-এ শেষ। মাঝের সময়টায় দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা ফ্র্যাংকো যা করেছেন তাতে সর্বকালের অন্যতম সেরা তো বটেই, ফুটবল মাঠে সর্বকালের সেরা নেতাও বলা চলে নির্বিবাদে।
ম্যারাডোনা-রূপকথার শুরুটা হয়েছিল ১৯৬০-এর কোনো এক শীতে। আরো বছর আটেক পর একদিন বুয়েনোস এইরেসের ছোট্ট এক শহরতলি ভিয়া ফিওরিতোর ছেলে ছোট্ট দিয়েগোর বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসলেন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র কোচ ফ্রান্সিস করনেহো। কারণ? কোচের বিশ্বাস, অত কম বয়সে এতটা ভালো কেউ খেলতেই পারে না। পরে মা দালমা সালভাদোরা জন্মসনদ দেখিয়ে প্রমাণ করলেন, বয়সের তুলনায় ছোট হলেও দিয়েগো আট বছর বয়সিই।
দলে আসার পর থেকে ছোট্ট ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র বয়সভিত্তিক দলটাকে করে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। মার্চ ১৯৬৯ থেকে টানা ১৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল তার দল।
নেতৃত্বগুণটা বেড়ে উঠেছিল সেই ছোটবেলা থেকে। ১২ বছর বয়সে পারিবারিক বারবিকিউ রাতের রাজা থেকে পরিবারেরই প্রধান ব্যক্তিতে রূপ নিতে সময় লাগল মোটে তিন বছর! এরও বছর তিনেক পর দলের সবার বকেয়া বেতনভাতা আদায়ে লড়লেন আর্জেন্টিনোস কর্তৃপক্ষের বিপক্ষে, ছাড়লেন ক্লাবও।
বোকা জুনিয়র্সে যোগ দিয়েছিলেন আরো অদ্ভুতভাবে। বন্ধুপ্রতিম এক সাংবাদিকের বরাতে আর্জেন্টিনোস ছেড়ে বোকায় যোগ দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা, এর আগে ফুটবল ইতিহাসে এমন কিছু হয়নি কখনো!
পরের গন্তব্য বার্সেলোনায় একটা বড় সময় চোট আর অসুস্থতাতেই কেটেছে। তবে সেখানেও স্মরণীয় হয়ে আছেন নেতৃত্বগুণ দিয়েই। কোপা দেল রের ফাইনালে স্প্যানিশ রাজার সামনে বিশাল এক বিবাদের মধ্যমণি ছিলেন ম্যারাডোনা, যার ফলে পড়তে হয়েছিল ঘরোয়া ফুটবলে পাঁচ মাসের নিষেধাজ্ঞাতেও।
তবে ম্যারাডোনার সত্যিকারের বুনো রূপটাকে বের করে এনেছিল নেপলস। ফিওরিতোর ছেলে দিয়েগো থেকে ‘ম্যারাডোনা—দ্য ব্র্যান্ড’-এ পরিণত করেছিল ন্যাপোলিই। দলটাকে জিতিয়েছিলেন দুটো সিরি’আ আর একটি ইউরোপা। বিশ্বের সেরা ফুটবলার হলে তার প্রমাণটাও দিতে হয় সময়ে-অসময়ে। কিন্তু ম্যারাডোনার পথটা আগলে দাঁড়িয়েছিল কোকেইন। নেপলসে যে কোকেইন তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল! তবে সেরা ফুটবলার আর তার চেয়েও বেশি কিছু হওয়ার মুহূর্তটা এসেছিল এরই মধ্যে। একবার ভাবুন, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ‘ঈশ্বরের হাত’ ম্যাচটায় ইংল্যান্ডকে হারাতে পারেনি, পারেনি চার বছর আগে ফকল্যান্ড যুদ্ধের ‘প্রতিশোধ’ নিতেও! সেদিন ম্যারাডোনা ছিলেন বলেই তেমনটা হয়নি। তাই তো আর্জেন্টিনায় রাজার মতোই সম্মান মেলে মহানায়কের!
এরপর ম্যারাডোনা নিন্দিত হয়েছেন নানা কারণে। সবচেয়ে বেশি হয়েছিলেন ২০১০ বিশ্বকাপের পর। সে বছর ট্রেবল জেতা ইন্টার মিলান থেকে জানেত্তি-ক্যাম্বিয়াসোদের দলে জায়গা না দিয়ে, ভেরনকে আর্জেন্টিনার জাভি আখ্যা দিয়ে কিংবা জার্মানির বিপক্ষে অদ্ভুতুরে একাদশ নামিয়ে। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনে ম্যারাডোনা যে নাম-যশ অর্জন করে গেছেন তাতে তা ম্লান হয় না মোটেও।
ব্যক্তি, খেলোয়াড় ও কোচ—যে চরিত্রেই হোক; অননুমেয় হওয়াটা ছিল ম্যারাডোনার সব চরিত্রেরই একটা বৈশিষ্ট্য। সেটা বিশ্বকাপ ফাইনালে লোথার ম্যাতায়াসের কড়া মার্কিং ভেঙে হোর্হে বুরুচাগাকে ফাইনাল পাস দেওয়া হোক কিংবা মিডিয়ায় এসে বেফাঁস কিছু বলে বসা, বড্ড অননুমেয়ই ছিলেন দিয়েগো। মৃত্যুটাও হলো সেই ম্যারাডোনা সুলভ ঢঙেই। কে ভেবেছিল, মাসের শুরুতে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার সয়ে যাওয়া লোকটা এভাবে চলে যাবেন হার্ট অ্যাটাকের কাছে হেরে? সেটাও হয়তো সম্ভব, তিনি ম্যারাডোনা বলেই!
ইত্তেফাক/জেডএইচডি