শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পর্ব-২

বাংলাদেশে ই-স্পোর্টস: টুর্নামেন্ট ও ইউটিউব থেকে আয় হচ্ছে

আপডেট : ০৭ জুন ২০২১, ১৪:২৭

করোনা ভাইরাসের মহামারিতে বিশ্বে যে কয়টি শিল্প খুব দ্রুত এগিয়েছে তার মধ্যে ই-স্পোর্টস অন্যতম। অনলাইন গেম খেলে অনেকেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা রোজগার করছে। বাংলাদেশেও অনেকে ই-স্পোর্টসকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। তবে ই-স্পোর্টস সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই।

সম্ভাবনাময় এই শিল্প সম্পর্কে তরুণ-তরুণীদের ধারণা দিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ইত্তেফাক অনলাইন। আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব-

 শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক ই-স্পোর্টস কি?

 অনলাইনভিত্তিক কম্পিউটার কিংবা মোবাইল গেমিং টুর্নামেন্টগুলোকে বলা হয় ইলেকট্রনিক স্পোর্টস বা ই-স্পোর্টস। পশ্চিমা দেশগুলোতে বড় বড় মিলনায়তন ও স্টেডিয়ামে জাকজমকভাবে এসব টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া গেমারদের বলা হয় পেশাদার ই-স্পোর্টস খেলোয়াড়। তারা দলগত কিংবা এককভাবে টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারেন।

 অনলাইন গেম খেললে সময়ের অপচয়, পড়ালেখার ক্ষতি ও মানসিক সমস্যা হয়-এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে আলোচনা হলেও এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। আমাদের দেশে এই শিল্প হতে পারে অর্থ আয়ের এক স্বর্ণ খনি। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও পাকিস্তানে ই-স্পোর্টসকে আনুষ্ঠানিক খেলার মর্যাদা দিলেও এখনো অন্ধকারে বাংলাদেশ। তবে কিছু তরুণের হাত ধরে সম্ভাবনাময় এই খাত দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেকেই পেশা হিসেবে ই-স্পোর্টসকে বেছে নিচ্ছেন।

 তাদেরই একজন রাজশাহীর তরুণ মোহাম্মদ শাকিল। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পেশাদার পাবজি মোবাইল খেলোয়াড় তিনি। সবাই তাকে সিনিস্টার হিসেবেই চিনে। খেলছেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পাবজি দল এ১ ই স্পোর্টসে। গত বছর দিয়েছেন এইচএসসি পরীক্ষা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন। ছোটকাল থেকেই ছিলো গেম খেলার শখ। সেই শখকে পেশা হিসেবে পরিণত করেছেন তিনি। তার পেশাদার ই-স্পোর্টস খেলোয়াড় হিসেবে জীবনযাপনের বিষয়টি তুলে এনেছে ইত্তেফাক অনলাইন-

 শুরুটা কীভাবে হলো?

বন্ধুদের থেকেই প্রথন শুনা হয় পাবজি মোবাইল গেমটির কথা। এতে নাকি সবার সঙ্গে কথা বলে খেলা যায়। আগে আমার এইরকম গেম খেলা হয়নি। তাই বেশ আকর্ষণ নিয়েই খেলা শুরু করি। বন্ধুদের সঙ্গেই শুরু দিকে খেলতাম। গেমটি অনেক হাই রেজুলেশনের আর শুরুর দিকে আমার দিকে উন্নত ডিভাইস ছিলো না। যার কারণে খেলতে অনেক বেগ পেতে হতো। এরপর আস্তে আস্তে টুর্নামেন্টগুলো সম্পর্কে জানতে শুরু করি। প্রথম টুর্নামেন্টটি আমি বন্ধু ও পরিচিত বড় ভাইদের নিয়েই খেলি। এর আর থামা হয়নি। সেসব প্রতিযোগিতামূলক খেলাগুলো খেলতে খেলতেই আমি কিছু ভালো খেলোয়ার খুজে পাই। যাদের মধ্যে দান্তে ও কাপশি অন্যতম। তাদের নিয়ে ২০১৯ সালের দিকে টাইটান ই স্পোর্টস দলটি গঠন করি। পরে সেখান থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৃষ্টি হয় এ১ ই স্পোর্টস দলটির।

বলে রাখা ভালো, শাকিলের নেতৃত্বাধীন এ১ ই স্পোর্টস বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পাবজি দল। গেমটির দেশীয় টুর্নামেন্টে দাপটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনাম কুড়িয়েছে দলটি।

 বাংলাদেশে ই স্পোর্টদের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

স্পন্সর ছাড়া এই খাতের উন্নতি করা একটু কঠিন। একটি দল পরিচালনা করতে হলে অনেক কিছু প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে স্পন্সর অন্যতম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দলগুলো ভালো স্পন্সর পেয়ে অনেক সুযোগ সুবধা পাচ্ছে। যা হয়তো আমাদের দেশের ই স্পোর্টস খেলোয়াড়রা পাচ্ছে না। সেসব সুযোগ তাদের স্ব-উদ্যোগে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এই খাত দ্রুত এগোচ্ছে। স্পন্সরের বিষয়টি আরও গতিশীল হলে দ্রুত এই শিল্প এগিয়ে যাবে। এতে পাবজির পাশাপাশি অন্যান্য গেমগুলোও দেশের বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। সেইসঙ্গে স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে গেমিংয়ের সাড়া বেশ ভালো। অনেকেই ইউটিউবসহ অন্যান্য স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে কাজ করছে।

 একজন পেশাদার ই স্পোর্টস খেলোয়াড় কী কী উপায়ে আয় করতে সক্ষম?

বিশ্বব্যাপী পাবজি গেমের প্রতিযোগিতাগুলোতে যেসব দল ভালো করছে তাদের খেলোয়াড়া বেতনভুক্ত। স্পন্সর ও টিম কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। তাদের কারও কারও মাসিক বেতন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি টুর্নামেন্টগুলোর প্রাইজমানি থেকে তো আয় আছেই। বাংলাদেশে বেতনের এই প্রক্রিয়া তেমন চালু হয়নি। আমরা যারা খেলছি তারা কেও বেতনভুক্ত না। টুর্নামেন্ট গুলো থেকে যেসব আয় হয় সেগুলোই আমাদের আপাতত উপার্জন। এছাড়া ইউটিউব ও অন্যান্য স্ট্রিমিং সাইট থেকেও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আয় হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা ভালো স্পন্সর পাবে, বড় বড় গেমিং প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে। আমাদের দেশের খেলোয়াড়রাও বেতনভুক্ত হয়ে খেলবে।

ছবি: ইত্তেফাক

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ শাকিলের বর্তমান মাসিক আয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা ১০-১৫ বছর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার পর একজন কর্মকর্তা আয় করেন। মূলত টুর্নামেন্ট ও স্ট্রিমিং সাইটগুলো যেমন- ইউটিউব ও লোকো থেকে আয় করছেন তিনি।

 বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, টুর্নামেন্ট খেলে এ১ ই-স্পোর্টস দলটি এখন পর্যন্ত আয় করেছে ৩৩ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ২৮ লাখ টাকা)। এছাড়া দলটির প্রত্যেকে স্ট্রিমিং সাইটগুলো যেমন- ইউটিউব ও লোকো থেকে আয় করছেন।

 ফুটবল, ক্রিকেটের পেশাদার খেলোয়াড়রা খেলার আগে নিজেদের অনুশীলন করে ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করেন। আপনাদের কী এমন কোনো বিষয় আছে?

অবশ্যই আছে। মোবাইল গেম হলেও আমাদের খেলার আগে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। জড়তা কাটাতে হয়। প্রতিদিন খেলার আগে আমরা ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত গেমে বিভিন্ন মুভমেন্টের অনুশীলন করি। যাতে করে ম্যাচে কোনো জড়তা কাজ না করে।

 গেম খেলা নিয়ে বাসায় কেমন সমালোচনার শিকার হয়েছেন এবং বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?

শুরুর দিকে তেমন সমর্থন পাইনি। রাত জেগে খেলা এবং অন্যান্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে জোরে কথা বলার জন্য অন্যান্যদের ঘুমের সমস্যা হতো। তাছাড়া দেরি করে ঘুমানোর কারণে দিনেও দেরি করে উঠতাম। সকালে প্রায়ই ক্লাস করতে পারতাম না। যার কারণে বাসা থেকে গেম খেলার জন্য শুরুর দিকে তেমন সমর্থন পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পাবজি বিশ্বক্যাপ খ্যাত পিএমজিসি কাপ খেলার জন্য যখন দুবাই গেলাম তখন সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাত জেগে খেলার জন্য তেমন কিছু বলেনা। সবদিক দিয়ে ভালোই সমর্থন পাচ্ছি।

সফলতা পাওয়ার পর বন্ধুরা কীভাবে সাপোর্ট করে?

তারা অনেক সাহায্য করে। আমি বাসা থেকে তেমন বের হই না। যদি জরুরী কিছুর প্রয়োজন তারাই এনে দেয়। সব সময় তারা আমাকে সমর্থন ও সাহায্য করে আসছে। আমার সাফল্যে তারাও খুশি।

 উন্নত দেশগুলোতে ই-স্পোর্টস সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার হলেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। সময় কি হয়েছে বাংলাদেশে ই-স্পোর্টসকে একটি ক্যারিয়ার হিসেবে গণ্য করার?

 বাংলাদেশে এই খাত দ্রুত এগোচ্ছে। খুব ভালো গ্রো হচ্ছে। এখন ই-স্পোর্টসের সুযোগ সুবিধা সীমিত থাকলেও ভবিষ্যতে এটি ফুলটাইম ক্যারিয়ার হতেই পারে। তবে যারা নতুন আসছেন বা আসতে আগ্রহী তাদের একাগ্র ও নিয়মিত থাকতে হবে। পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া উন্নতি পাওয়া অনেক কঠিন হবে। সেইসঙ্গে আপনাদের পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে হএ। মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

 ইত্তেফাক/টিআর