করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৬ আগস্ট মারা যান প্রকৌশলী জাকারিয়ার মা, ৩১ আগস্ট মারা যান তার দন্ত চিকিৎসক স্ত্রী। সেগুনবাগিচা কোয়ান্টাম দফতরে স্ত্রীকে গোসল করাতে নিয়ে এসে জাকারিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইত্তেফাককে তিনি জানান, তার বোনের অবস্থাও ভালো না। আগস্ট মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে নারী মৃতের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিকা না নেওয়া, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন না হওয়া এবং ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার এর মূল কারণ।
১২ আগস্ট প্রথমবারের মতো নারী মৃতের সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে যায়। ঐদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১০৮ জন নারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর পুরুষ মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৭। শেষবারের মতো নারীর মৃতের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি দেখা যায় ৩০ আগস্ট। উক্ত তারিখে মোট ৯৪ জন মৃতের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ৪৯, যেখানে পুরুষ ছিল ৪৫। এর এক দিন আগে পরপর দুই দিন নারী মৃতের সংখ্যা বেশি ছিল। ২৯ আগস্ট নারী মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৮, যেখানে পুরুষ ছিল ৪১। আর ২৭ আগস্ট নারীর মৃতের সংখ্যা ছিল ৬১, যেখানে পুরুষ ছিল ৫৬।
শুরু থেকে পুরুষের তুলনায় নারী আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম হলেও দৈনিক মৃত্যুর খাতায় চলতি বছর ১ মার্চ নারী ও পুরুষের মৃতের সংখ্যা সমান দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মূলত মার্চ মাস থেকেই নারী মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যু হয়। ঐ মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এক বছর পরে ২০২১ সালের মার্চে এসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪১৬। এ সময় নারীর মৃত্যুর হার ছিল ২৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর পুরুষ মৃত্যুর হার ছিল ৭৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাঁচ মাস পরে আগস্টে শেষে এসে দেখা যায় নারী মৃত্যুর হার বেড়ে ৩৫ দশমিক ১৫ এবং পুরুষ মৃত্যুর হার কমে ৬৪ দশমিক ৮৫ হয়। জুলাইয়ে নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে ২৯ শতাংশে উঠে যায়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তা ৩৩ শতাংশ ছাড়ায়। মহামারির এক বছরে নারী মৃত্যুর হার ছিল পুরুষের অর্ধেকেরও অনেক কম।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস পরিচালক ও এইচআইএস এবং ই হেল্থ লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, নারীরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তুলনামূলক সচেতন কম। তারা বাড়ির কেউ আক্রান্ত হলে তাদের সেবা করার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। আবার নিজেদের রক্ষা করার জন্য টিকাও নেন না। পর্যবেক্ষণে করে দেখা গেছে, নারী মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মূল কারণ টিকা না নেওয়া। আবার এখন নারীরা বেশি বাইরে বের হচ্ছে।
গত ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময় ১ হাজার ২৮৬ জন নারী ও ১ হাজার ৪২৫ জন পুরুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মোট সংখ্যার হিসেবে নারীর মৃত্যু কম হলেও ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের পর অগাস্ট মাসেই লাফিয়ে বাড়ে নারী মৃত্যুর হার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করে মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার ৮৩৯ । আর নারী ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯০৩ জন। ঐদিন পর্যন্ত ৫৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৪২ দশমিক ৫৬ শতাংশ নারী প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ মনে করেন, অনেকগুলো কারণেই নারীর করোনায় মৃত্যু বেড়েছে। নারীরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে বলেই বেশি মারা যাচ্ছে। নারীরা এখন ঘরের বাইরে বেশি আসছে। শনাক্তকরণে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেশি। আবার ডেলটার পরিবর্তিত ধরন হরমোনের কারণেই নারী ও শিশু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আর টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকা একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, নারীর নিজের প্রয়োজনে নিজে আগ্রহী হলে ভালো, আর তা না হলে সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে নারীকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
ইত্তেফাক/কেকে