বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কেন বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

আপডেট : ১৪ জুন ২০২২, ১৮:১৩

দেশে করোনার সংক্রমণ যখন কমছে, তখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন দুই শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন। এছাড়া করোনাকালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সব খবর গণমাধ্যমে আসে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু সংক্রান্ত সব তথ্য সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। এমনকি এই নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই। সমন্বিতভাবে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না। চলতি বছর শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। এতে ডেঙ্গু চিকিৎসার অবস্থা অনেকটা বেহাল হয়ে পড়েছে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর ধরনে কিছু পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়েও তারা বেশ কিছু কারণকে দায়ী করেছেন।

১৪ বছরের দিহানের গত দুই দিন ধরে জ্বর, মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব। তাই একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে তাকে নিয়ে এসেছেন অভিভাবক। দিহানের শরীরে রোগের লক্ষণগুলো জেনে চিকিৎসকের ধারণা, তার ডেঙ্গু হয়েছে। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডেঙ্গু টেস্ট করালেন। টেস্টের রিপোর্ট বলছে, দিহান ডেঙ্গু আক্রান্ত। এ চিত্র কেবল দিহানের নয়, এমন শত শত চিত্র পুরো রাজধানীজুড়ে।

বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, চিকিৎসার জন্য তাদের শুধু অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, তাই নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে গেলে দেওয়া হচ্ছে করোনা টেস্টের শর্ত। বেসরকারি হাসপাতালে গেলে হাজার হাজার টাকার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করলে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ৪১ হাসপাতালে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর থেকে এই সংখ্যা আর বাড়েনি। এখনো ওই হাসপাতালগুলো থেকে পাঠানো তথ্যই সামগ্রিকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। যা প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য থেকে অনেক কম। অথচ শুধু ঢাকা শহরেই দুই শতাধিক বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। সাড়ে চার শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করা হয় পরীক্ষা। হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে এসব তথ্য।

এদিকে, গত ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘দেশে এডিস মশা বিস্তারের অন্যতম কারণ আবহাওয়া। আবহাওয়া অনুকূলে এলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ায় ডেঙ্গু বেশি ছড়িয়েছে।’

শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর এফডিসিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে নগরবাসীর সক্রিয় ‘অংশগ্রহণ নিয়ে ছায়া সংসদ’-এ অংশ নিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া অসহায় পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হবে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের মশা নিধনকর্মীরা কাজ করছেন। নগরবাসীকে সচেতন করে যাচ্ছি। আমি মনে করি ডিএনসিসিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’

তবে, দুই মেয়র ও মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরও আশা দেখছেন না নগরবাসী। তারা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন তেমন কিছু করছে না। বরং নাগরিকদের দায়ী করে জেল-জরিমানা করছে। এভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এলাকার ঘরে ঘরে ডেঙ্গু হানা দিয়েছে। শুনেছি আমাদের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৯ জন মারা গেছে। একটি ওয়ার্ডেই যদি এতজন মারা যায়, বাকিগুলোর অবস্থা বুঝে নিন। আর সিটি করপোরেশন নামে আছে কাজে নেই।’

বিসিএসআইআর’র উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলো- ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। দেশে ডেনভি-৩ শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সবশেষে ২০১৯ সালে মহামারি আকার ধারণ করে এটি।

অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিম খান বলেন, ‘দেশে প্রথম এই ধরন শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। তার আগে ডেনভি-১ ও ২-এ আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠেছে অনেকের। কিন্তু ডেনভি-৩ এর বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। যারা আগের দুই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত, তারা নতুন করে ডেনভি-৩ আক্রান্ত হলে হেমোরেজ বা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছেন। তাই এবার মৃত্যু বেশি।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ‘প্রতিদিন যে পরিমাণে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হতে আসছেন, আমরা সবাইকে ভর্তি করতে পারছি না। হাসপাতালের সব শয্যায় রোগী ভর্তি থাকায় নতুন রোগীর জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এবং মশা নিয়ন্ত্রণ না করায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এ অবস্থায় রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক বা একাধিক ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড  করলে চিকিৎসা দিতে সুবিধা হয়। হাসপাতাল ডেডিকেটেড করার প্রয়োজন নেই। আর ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করে চিকিৎসা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশও বিজ্ঞানসম্মত নয়।’

এদিকে, শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুল কিবরিয়া স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৮৭ জন রাজধানী ঢাকার ও বাকি ৪৫ জন ঢাকার বাইরের।এ নিয়ে সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৯৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৯৯০ জন ও বাইরের বিভিন্ন বিভাগে ২০৭ জন চিকিৎসাধীন।

 

ইত্তেফাক/এনএ/এনই/টিএ

এনএ