শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইভ্যালি, লাভ, লোভ ও দৌড়

আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৪৭

পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে ব্যবসা করেছে বাংলাদেশি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। প্রথম দিকে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হয়েছিল। পরে তা ৪০ শতাংশ করা হয়। অর্থাত্ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়ার লোভনীয় এই অফারে হাজার হাজার গ্রাহক আকৃষ্ট হয়েছেন।

পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম টাকা জমা দিয়েছেন। কেউ কেউ লাভবানও হয়েছেন। আর বাকিরা ছিলেন লাভবান হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইভ্যালির ‘জাদুর বেলুন’ চুপসে গেছে। মামলা হওয়ায় এর কর্মকর্তারা এখন জেলে আছেন। আর গ্রাহকরা পাওনা টাকার জন্য বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশের পিটুনি খেয়েছেন। লোভে পড়ে গ্রাহকরা ধানগাছে তক্তা আশা করেছিলেন। এখন আর বিক্ষোভে কী ফল হবে?

যে জিনিসটা সবার বোঝা উচিত যে, বিক্রেতা বা কোম্পানি আপনাকে পণ্যের সঙ্গে ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ টাকা ফেরত দিচ্ছে, সে কীভাবে তা দিচ্ছে? নিশ্চয়ই তিনি পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে বা পকেট থেকে দেবেন না। সেটা দিলে দেবেন অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা অন্য কোনো অনৈতিক উপায়ে। খুবই স্বাভাবিক নিয়মে ইভ্যালির প্রায় ৯৫ শতাংশ গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন।

How to get rid of greed for money - Quora

ইভ্যালির মতো জোচ্চুরির প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার জন্য লাখ লাখ মানুষের লাইন দেওয়া—এর পেছনে রয়েছে লোভ। আমাদের দেশের মানুষ এখন লোভের পেছনে, লাভের পেছনে ছুটে চলেছে। এই যে দেশে এত এত চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা—এসবের কারণও কিন্তু স্রেফ চটজলতি বড়লোক হওয়ার দৌড়। এই দৌড়ে কেউ পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। তাই তো ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাহীন সবাই চায় ফাস্ট হতে, যে কোনো মূল্যে দ্রুত বড়লোক হতে। এজন্য সবাই রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে।

উসাইন বোল্ট, কার্ল লুইস, বেন জনসন কিংবা মার্সেল জ্যাকবসের দৌড় নয়, আসলে আমাদের সময় কাটে অন্য এক দৌড়ের মধ্যে। এর নাম জীবনের দৌড়। এ দৌড়ে ক্লান্তিহীন আমরা লড়েই চলেছি। যদিও এর কোনো স্বীকৃতি নেই। আমরা সবাই কমবেশি দৌড়ে অভ্যস্ত। জন্মগ্রহণের পর প্রথম কয়েকটা বছর কোলে-দোলনায় ট্যাঁ ট্যাঁ। তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে আরো কিছুদিন। তারপর শুধু দৌড় আর দৌড়। কবর কিংবা চিতায় না যাওয়া পর্যন্ত কিংবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় না পড়া পর্যন্ত দৌড় চলতেই থাকে। সেদিক থেকে আমরা প্রত্যেকেই একেক জন ছোটোখাটো উসাইন বোল্ট।

যদি বলি ধনী হওয়ার, বড়লোক হওয়ার দৌড়ে অংশগ্রহণের জন্য মানুষের জন্ম হয়েছে—তাহলে সম্ভবত খুব একটা ভুল বলা হবে না। পা-হীন ব্যক্তিও গড়িয়ে গড়িয়ে অথবা কৃত্রিম কাঠের পা-লাগানো ব্যক্তিও লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়। মানুষ নানা কারণে দৌড়ায়। কুকুর বা ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে, ডাকাতের ভয়ে, উত্তেজিত জনতার ধাওয়া খেয়ে, প্রতিপক্ষের তাণ্ডবে ভীত হয়ে, পুলিশের প্যাঁদানি এড়াতে কিংবা নিদেনপক্ষে আপন স্ত্রীর রুদ্রমূর্তি দেখে কিংবা স্বামীর অসুর আচরণের মুখে মানুষ দৌড়ায়। জীবনে একবারও দৌড়ায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছোটকালে যখন স্কুলে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন সাদা অ্যাপ্রোন পরে টিকা দিতে আসত তখন আমরা সেই টিকা-বিভীষিকা থেকে রেহাই পেতে দল বেঁধে মাইলের পর মাইল দৌড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতাম। সেই দৌড়ের স্মৃতি আজও অম্লান।

Greed designs, themes, templates and downloadable graphic elements on  Dribbble

আগে এলাকায় এলাকায় স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ ইত্যাদি বিশেষ দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে একটা ‘অনিবার্য’ আইটেম ছিল দৌড় প্রতিযোগিতা। সেসব প্রতিযোগিতায় আমরা অনেকেই অংশগ্রহণ করেছি। সেসব প্রতিযোগিতার মর্মবাণী ছিল—বিজয়ী হওয়া নয়, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটাই বড় কথা। সেই মর্মবাণী আমাদের জীবন চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়েছে। আমরা জীবনের নানা ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছি, এখনো করছি। সাফল্য খুব একটা আসেনি। তাতে কী? অংশগ্রহণই যে বড় কথা! এটা যেন ইভ্যালির পণ্য কেনার মতো। পণ্য পাননি, তাতে কী হয়েছে? টাকা তো দিয়েছেন! পণ্য কেনার দৌড়ে তো অংশ নিয়েছেন !

ছোটকালে ‘উলটো দৌড়’ বলে একধরনের প্রতিযোগিতায় আমরা অংশ নিয়েছি। সেখানে উলটো দিকে দৌড়ানো হতো; ব্যাপারটা খুবই আমোদজনক (একই সঙ্গে বেশ প্রতীকীও। আমাদের দেশের একশ্রেণির আমলা ও রাজনীতিক সব সময় এই প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী। দেশটাকে উলটো দিকে পৌঁছে দিতে তাদের জুড়ি নেই)। এ দৌড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিতপটাং হয়ে পড়ে যেত প্রতিযোগীরা। অনেক সময় পুরস্কার দেওয়ার মতোও কাউকে পাওয়া যেত না। এর জন্য উদ্যোক্তারা এ প্রতিযোগিতাটাকেই গুরুত্ব দিতেন বেশি।

আমরা যারা জীবনের মধ্যগগনে বা পড়ন্ত বেলায় অবস্থান করছি, তারা অনেকেই এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে রয়েছি। যেন বুনো ষাঁড় বা পাগলা কুকুর তাড়া করছে। সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছি। শুধুই ছুটছি। এ ছুটে চলা সাধারণ অর্জনের জন্য। অসাধারণের জন্যও। ছাত্রলীগ, যুবলীগের সদস্য হওয়া, পদ, পদবি, শিক্ষা, চাকরি, প্রতিষ্ঠা—সবকিছুর জন্যই দরকার দৌড়। প্রবল বেগে ছুটে চলা। ঘণ্টায় ১০০, ২০০, ৩০০ কিলোমিটার বেগে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাপনের গতি। এটা গতি, অগ্রগতি, প্রগতি নাকি অধোগতি, সেটা আল্লাহ মালুম!

7,334 Greed Cliparts, Stock Vector and Royalty Free Greed Illustrations

এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সমাজটা দ্রুত বদলাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে তত পরিবর্তনের গতি বাড়ছে। আর পরিবর্তনের নিয়মে তার ছন্দও বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে নিয়মকানুন-মূল্যবোধ-সংস্কৃতি—সবকিছু। এই দৌড়ের উন্মাদনায় আমাদের আর হুঁশ নেই। জীবন পালটে গেছে। জীবিকা বদলে গেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে অধ্যয়ন নয়—টাকা কামাই করতে পারাটাই আসল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই আছে; নেই ক্লাস, প্রকৃত জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন। আছে বক্তৃতা, স্লোগান, উত্তেজনা। দলাদলি আর দালালি। সমুদ্রের চরের মতো অল্প কিছু ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। আমলা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদের সন্তানরা সেখানে লেখাপড়া করে। তারপর সোজা বিদেশে। এরা উপরে উঠবে হুহু করে। আলাদা সমাজ তৈরি হবে। এরা কন্ট্রোল করবে অর্থনীতি। তৈরি করবে রাজনীতি-কৃষ্টি-কালচার। যে কালচার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবে টিভি পর্দায়, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের কলামে।

এখন চটজলদির যুগ। সিঁড়ি নয় লিফট। লন্ড্রির বাইরে আজকাল লেখা থাকে—এক ঘণ্টায় আড়ং ধোলাই ও ডেলিভারি। সমস্ত অফিস কম্পিউটারাইজ। মিনিটে চেক ক্লিয়ার। ম্যারেজ রেজিস্ট্রির অফিসে পাঁচ মিনিটে বিয়ে। সাত মাসেই সিজারিয়ান বেবি। এক মিনিটে কালার ফটো। ইনস্ট্যান্ড কফি, ফাস্ট ফুড। হিট অ্যান্ড রান। ধরো আর মারোর যুগ। এখন গাইড বইয়ের নাম দেওয়া হয়—‘টাচ অ্যান্ড পাশ’। সবাই এখন ‘মেড-ইজি’ খোঁজে। সবকিছু যত দ্রুত সম্ভব শেখা-বোঝা-গেলা যায় ততই মঙ্গল।

আমাদের চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই ছুটছে, সবাই ফার্স্ট হতে চায়। শুধু চলা, ছুটে চলা। এখনকার সিনেমা বড়জোর দেড় ঘণ্টার। এক-দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপিংস জনপ্রিয় হচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে মানুষের আগ্রহ কম। ওয়ানডেও এখন দর্শক টানতে পারে না। টি-টোয়েন্টিতে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়।

সংক্ষিপ্ত ও চটজলদির এ যুগে আমাদের যে জীবন সাজানো হয়েছে সেখানে রয়েছে—মোবাইল-ইন্টারনেট, ফাইভজি, বিজ্ঞাপন-মিডিয়া-কম্পিউটার-স্যাটেলাইট ইত্যাদি। এই ‘ভার্চুয়াল’ ছায়াজীবনে আমরা সেকেলেরাও দৌড়ের মধ্য দিয়েই চলছি। অথচ জায়গামতো পৌঁছতে পারছি না। আরো জোরে আরো জোরে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পেছনের জনের ল্যাং খেয়ে ধরাশায়ী হতে হচ্ছে। তখন মওকা খুঁজছি আমার সামনের জনকে ল্যাং মারার!

সমৃদ্ধি, অর্থ, খ্যাতি, যশ, ক্ষমতা, রূপসী স্ত্রী, নধর সন্তান সবকিছুর জন্য রুদ্ধশ্বাসে আমরা দৌড়ে চলছি। যেন এ দৌড়ের শুরু আছে, শেষ নেই। জীবনের এ পর্বে এসে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে বলতে ইচ্ছে করে—‘যাহা চাই তাহা পাই না, যা পাই/ হারাই কপাল দোষে।/ মুঠো করে যত চেপে ধরি এই/ জীবনটাকে,/ পথের ধুলায় ছিটাইয়ে যায়/ হাতের ফাঁকে।/ চাই ধন জন স্বাস্থ্য শান্তি,/ অভাবে পাই/ রুগ্ণ পত্নী, মূর্খ পুত্র/ গোঁয়ার ভাই’ (যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত)!

পরিশেষে একটা পুরোনো কৌতুক।

একটা ট্রফি হাতে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল এক লোক।

তার স্ত্রী বলল, ‘একি! এত হাঁপাচ্ছ কেন? এই ট্রফিটাই-বা কোথায় পেলে?’

লোকটা বলল, ‘দৌড় প্রতিযোগিতায় দুজনকে হারিয়ে এটা পেলাম।’

স্ত্রী বলল, ‘মাত্র তিন জন নিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা?’

লোকটার জবাব, ‘হ্যাঁ, প্রথমে আমি, তারপর পুলিশ আর সবার পেছনে এই ট্রফির মালিক।’

লেখক : রম্যরচয়িতা

ইত্তেফাক/এএইচপি