শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

খাদ্যচক্রে বিষাক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২১, ১৩:০১

প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব চারপাশ। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত দুই দশকে শুধু রাজধানীতেই প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে তিন গুণের বেশি। অথচ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার কিংবা পলিথিনের বিকল্প তৈরিতে নেই কোনো উদ্যোগ। নগরবাসীর অসচেতনতায় ভয়ংকর পরিণতির পথে এগোচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ। সরকার পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের কথা বললেও, দেশের পাটকলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহারে দিনদিন উত্সাহ হারাচ্ছে। অন্যদিকে দামে সস্তা ও ব্যবহারে সহজলভ্যতার কারণে পলিথিন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে প্রায় ১ হাজার বছর। সেজন্যই প্লাস্টিক বর্জ্য কীভাবে রিসাইকেল করা যায়—তা বিজ্ঞানীদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। সারা দুনিয়ায়ই প্লাস্টিক বিশেষ করে এক বার ব্যবহৃত হয় এমন প্লাস্টিক পণ্য এক বিশাল সমস্যা। রাজধানীর খাল-নর্দমা পরিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় প্লাস্টিকের বোতল। আর এ কারণেই বর্ষা এলেই রাজধানী জুড়ে জলজট তৈরি হয়। ব্যবহারের পর এসব জিনিস বিভিন্ন জলাশয়ে ও যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। ফলে দিনদিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিনদিন পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে।

আইন করে ২০০২ সালে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এমন কি উভয় দণ্ড হতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৮৯৭টি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ৫ হাজার ৯৫৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। পলিথিন ব্যবহারের কারণে ৯১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হতো। সেখানে ২০২০ সালের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৬৪৬ টনে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ২ কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা প্রভৃতি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ৮৭ শতাংশই পরিবেশবান্ধব সঠিক ব্যবস্থাপনায় নির্মূল করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে এক মাসে সে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয় না। পলিথিন ও প্লাস্টিক যে পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা এখানকার বেশির ভাগ মানুষই জানে না। বাংলাদেশের জলে-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন করে যোগ হচ্ছে। এর ১৭ শতাংশই প্লাস্টিক জাতীয়। এসব বর্জ্যের অর্ধেকই সরাসরি পানিতে বা নিচু ভূমিতে ফেলা হয়। বাংলাদেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব মিহির বিশ্বাস জানান, আইনে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সারা দেশে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিনের কারণে পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে জমা ৬-১০ ফুট পলিথিনের স্তর। সাগরে মাছের তুলনায় পলিথিনের সংখ্যা বেশি। ড্রেনগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যে ভরে গেছে। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও নেই কোনো বিকল্প পণ্য। পাটের ব্যাগকে জনপ্রিয় করতে পারেনি সরকার। প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ ঠেকাতে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করা অপরিহার্য মনে করেন তিনি।

ইত্তেফাক/ইআ