শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অনন্ত যৌবনা বসন্তের প্রারম্ভে ইস্টারের স্লোভেনিয়া!

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২০, ০৩:০৩

এপ্রিল মাস। ইউরোপে বলতে গেলে বসন্ত এসেই গিয়েছে। কয়েক দিন আগেও রাস্তার ধারে নির্জীব আর প্রাণহীনভাবে যে সকল গাছ পড়েছিলো এপ্রিল আসতে না আসতে একেবারে অবিশ্বাস্য ভাবে গাছগুলো ভরে উঠেছে সবুজ কচি পাতায়। পত্রপল্লব ভরে উঠছে নতুন ফুলে।

কেউ বিশ্বাস করবে না কয়েক দিন আগেই প্রকৃতির প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর; এপ্রিল আসতে না আসতেই প্রকৃতি যেনও একেবারে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। চারদিকে পাখিদের কলতান, মৌমাছিগুলো যেনও ছুটে চলেছে আপন গতিতে ফুল থেকে পুষ্প রস সংগ্রহ করতে। রোদেলা ভোরের বাতাস সত্যি মৃদুমগ্ন, এক চিলতে বসন্তের রোদ যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ হীরের টুকরো থেকেও দামি। 

ইউরোপে বসন্ত যেনো সত্যি অসাধারণ, ব্যাকরণের কোনও উপমা দিয়ে তার সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। 
প্রকৃতিতে বসন্তের রং লাগলেও পুরো পৃথিবীর মতো ইউরোপে এখনও মানুষের মন যেনও সেই রিক্ত শীতের দিনের তুষারে মুড়ে রয়েছে। স্লোভেনিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।  চারদিক যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় একে একে যেখানে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঠিক এমন একটি দুর্যোগকালীন মুহূর্তে স্বভাবতই সবাই অনেকটা ভীত ও সন্ত্রস্ত। তবুও মানুষ বাঁচে আশায়, শত বিপর্যয়ের মধ্যেও এক টুকরো আনন্দকে উপজীব্য করে সে চায় সামনে এগিয়ে যেতে।

মার্চের শেষ দশক থেকে আরম্ভ করে এপ্রিল। বসন্তের এ আগমনী মুহূর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ইস্টার উৎসবে মেতে উঠে। ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী খ্রিস্টান ধর্মের মানুষদের কাছে বড়দিন বা খ্রিস্টমাসের পর ইস্টার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।

ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের তিন দিন পরে মৃতাবস্থা থেকে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের বেঁচে ওঠা তথা পুনরুত্থানের অলৌকিক ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা এ ইস্ট উৎসব পালন করেন।

ইস্টারকে বিবেচনা করা হয় পুরাতন জীবনের অবসানের পরে নতুন জীবনের শুরুর প্রতীক হিসেবে। বাসা-বাড়ি থেকে আরম্ভ করে রাস্তা-ঘাঁট, শপিং মল সব কিছু সুসজ্জিত করা হয়। তবে ইস্টারের মূল আনুষ্ঠানিকতা থাকে বানি কিংবা ছোটো আকৃতির এক ধরণের খরগোশকে ঘিরে। ইস্টারের সকল সাজ-সজ্জার কেন্দ্রবিন্দু এ বানিকে ঘিরে যদিও আধুনিককালে বানির পাশাপাশি স্টার এগ নামে আরও একটি নতুন ডেকোরেশন সিম্বলের প্রচলন ঘটেছে। এমনকি শপিং মল বা বেকারিগুলোতে এ সময় বানি আকৃতির চকলেট বিক্রি করা হয়।

 ইউরোপিয়ানদের কাছে বানি অত্যন্ত আদরের প্রতীক এবং খরগোশের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সাথে বসন্তের মতোই নতুন এক আগমনী বার্তা ও উদ্যমতার সম্পর্ক বিবেচনা করা হয় যার প্রভাবে বছরের এমন সময় উদযাপিত এ ইস্টার উৎসবের মূল আকর্ষণ থাকে এ বানিকে ঘিরে।

২১ শে মার্চ থেকে ২৫শে এপ্রিল যে কোনও এক রবিবারকে ইস্টার উৎসবের জন্য বেছে নেওয়া হয় এবং কোন রবিবার আসলে নির্বাচিত হবে এ ইস্টার উৎসব পালনের জন্য সেটা নির্ভর করবে আকাশের চাঁদের ওপর। বছরের এ সময় যখন ভরা পূর্ণিমা থাকবে তার কাছাকাছি কোনও রবিবারকে বেঁছে নেওয়া হবে ইস্টার সানডে উৎসবের জন্য।

যদিও ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে মানুষ এখন সে অর্থে আর ধর্ম পালন করে না তবুও খ্রিস্টমাস কিংবা ইস্টার এ ধরণের উৎসবের সময় আনুষ্ঠানিতার দিক থেকে কোনও ধরণের কার্পণ্য রাখা হয় না। পরিবারের সকল সদস্য এ সময় একত্রিত হয়। খ্রিস্টমাসের মূল আয়োজন থাকে ডিনার কিংবা রাতের খাবারকে ঘিরে আর ইস্টারের মূল আয়োজন থাকে ব্রেকফাস্ট বা সকালের নাস্তাকে ঘিরে। স্লোভেনিয়ানরা পারিবারিক জীবনের প্রতি অনেক বেশী মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল এবং এখানে ছুটির দিন মানেই সকল কিছুকে ভুলে পরিবারকে নিয়ে সময় কাটানো। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্লোভেনিয়াতে এ কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে কম বলে বেশ কিছু গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে।

তবে এ বছর ইস্টারের আনুষ্ঠানিকতা অনেকটাই শূন্যতা দিয়ে গাঁথা আর এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও বিস্তার লাভ করা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রভাব। তবুও মানুষের উৎসাহ থেমে নেই। গত ১৯ শে মার্চ থেকেই সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়া জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং গত বুধবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও দুই থেকে চার সপ্তাহ বহাল রাখা হতে পারে।তবুও বসন্তের আগমনের সাথে সাথে এ ইস্টার উৎসবকে ঘিরে মানুষ চাইছে নতুন কোনও আশার আলো খুঁজে পেতে।

মধ্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে ইস্টারকে স্বাগত জানানো হয় পোটিছাকে ঘিরে, পোটিছা হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের পেস্ট্রি রোল।ভেতরে থাকে ওয়ালনাট বা আখরোটের পুর। তবে অনেক সময় টাররাগোন নামক এক বিশেষ ধরণের দ্বি-বর্ষজীবী গাছের পাতা কিংবা কোয়ার্ক নামক এক বিশেষ ধরণের দুগ্ধজাত দ্রব্য অথবা হেজেলনাট কিংবা মিষ্টিকুমড়ার বীচি বা পোস্তদানা ব্যবহার করেও ভেতরের পুর দেওয়া হয় তবে বেশীর ভাগ সময় ওয়ালনাট ব্যবহার করা হয়।

ময়দা , ডিম ও বাটারের সহযোগে তৈরি খামিরের ভেতর মিষ্টিজাতীয় ইস্ট দিয়ে গাছের গুঁড়ির আকৃতির খামিরের তৈরি করা হয় এবং এর ভেতর বাটার ও ওয়ালনাটের পুর দিয়ে ওভেনে বেক করা হয়। এভাবেই তৈরি হয় পোটিছা। মার্চের শেষ থেকে আরম্ভ করে এপ্রিল গোটা সময় জুড়ে স্লোভেনিয়াতে পোটিছা মানুষের খাবারের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে থাকে এবং বেকারিগুলোতে এ সময় পোটিছা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। কনফেকশনারি দোকানগুলো পোটিছার বিজ্ঞাপনে ছেঁয়ে যায়। ইস্টারের দিন সকাল বেলায় তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথেই স্লোভেনিয়াতে সবাই এ পোটিছা খেয়ে থাকে। 

পোটিছার সাথে অন্যান্য ডেজার্ট আইটেমও থাকে সকালের নাস্তায়। এছাড়াও থাকে বিভিন্ন ধরণের পনির, বাটার, পাউরুটি, সিদ্ধ ডিম, দুধ, সালাদ, কয়েক প্রকারের সসেজ ও সেলামি, বিভিন্ন ধরণের ফল ও ফলের তৈরি জুস এবং জ্যাম, মধু এবং মাংসের পাতলা স্লাইস বা বেকন নামে পরিচিত। প্রতীচ্যের ব্রেকফাস্ট বলতে যা বোঝায় আর কি। ছোটো বাচ্চাদের অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন ধরণের কস্টিউমে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ছুটে যেতে। সাধারণত বাচ্চারা এ সময় বাড়িতে আসলে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের চকলেট উপহার দেওয়া হয়।

এছাড়াও ইস্টারের দিন বাচ্চাদের আগ্রহ থাকে ডিম যুদ্ধ নিয়ে। ইস্টার সানডের ঠিক পূর্বের শুক্রবার স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে ডিম কিনে আনা হয়, অতঃপর ডিমকে সিদ্ধ করে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করে রবিবারের জন্য অপেক্ষা করা হয়। ইস্টার সানডের সকালে বাচ্চারা ডিম যুদ্ধ খেলে। প্রথমে একজনের ডিম দিয়ে অন্যজনের ডিমকে আঘাত করতে হয়। এরপর প্রতিপক্ষ আবার তার ডিমে আঘাত করবে। যার ডিম বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হবে সেই আগে ডিমটি খাবে। এছাড়াও ইস্টারের বিশেষ রান্নার মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরণের ফিস গ্রিল এবং পাশাপাশি ফিস সুপ।

করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এ বছর ইস্টার উৎসব আয়োজনে ভাঁটা পড়লেও স্লোভেনিয়ার অনেক মানুষের বিশ্বাস সদ্য আগত চির যৌবনা বসন্তের মতো নতুনের বার্তা নিয়ে দুয়ারে কড়া নড়ানো এ ইস্টার উৎসবের পর খুব শীঘ্রই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং খুব শীঘ্রই সব কিছু আবার নতুন উদ্যমে ফিরে যাবে চিরচেনা রূপে। 


শিক্ষার্থী,
দ্বিতীয় বর্ষ,
ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া!

ইত্তেফাক/এসআই