শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মাধবকুণ্ডে ফিরেছে প্রাণ-প্রকৃতি

আপডেট : ১৭ মে ২০২১, ১২:১৯

একদল বানর গাছে গাছে লাফালাফি করছে। বনের ভেতর বিরামহীন ডাকছে ঝিঁঝিঁ পোকা। সেই ডাক বনের ভেতর তৈরি করছে শব্দ-তরঙ্গ। শ্যাওলা জমে থাকা পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে এগোতেই শোনা গেল জলপতনের গমগম আওয়াজ। একটি বড় পাহাড়ি কাঁকড়া হাঁটছিল পাথরের ওপর দিয়ে। মানুষের সাড়া পেয়ে লুকিয়ে পড়ল পাথরের ফাঁকে।

এমন দৃশ্য মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক ও জলপ্রপাত এলাকার। দেশের অন্যতম এই জলপ্রপাত পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে বিপুলসংখ্যক ভ্রমণপিপাসুর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে জলপ্রপাত এলাকা। প্রতিদিনই লেগে থাকে ভিড়। অনেক বছর ধরে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের চেহারা এ রকমই। কিন্তু গত প্রায় একবছর ধরে পালটে গেছে মাধকুণ্ডের চিত্র। করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই দফায় মাধবকুণ্ড বন্ধ ঘোষণা করায় পর্যটকরা ভেতরে প্রবেশ করছে না।

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে গত এপ্রিল মাস থেকেই বন্ধ মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক। সেই থেকে নেই পর্যটকদের আনাগোনা। তবে পর্যটকহীন জলপ্রপাত এলাকায় ফিরেছে প্রাণ-প্রকৃতি। প্রকৃতি তার রূপ মেলে ধরেছে নিজের মতো করে। জালপ্রপাত এলাকার ফাঁকা জায়গাগুলোতে মাথা তুলছে বুনো ঘাসলতা, জেগে উঠছে চেনা-অচেনা গাছ। জলপ্রপাতের কাছে পাথরে পাথরে ছড়িয়ে আছে ছোটবড় শামুকের ঝাঁক। শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, ইকোপার্কের ভেতরে অস্থায়ী দোকানের বাক্সগুলো রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। পর্যটকদের চলাচল না থাকায় চলার পথে শ্যাওলা জমে উঠেছে। রাস্তার ওপর চলে এসেছে বুনো ঘাসলাতা। রাস্তা, পাথরে পাথরে ছড়িয়ে আছে ছোটবড় শামুকের ঝাঁক। ঘুরছে পাহাড়ি কাঁকড়াও। পর্যটকহীন জলপ্রপাতের ছড়ায় মাছ শিকার করছেন আদিবাসী যুবকরা। জলপতনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এই দৃশ্য পর্যটকের উপস্থিতির সময় কখনোই দেখা যেত না। তবে মানুষের আনাগোনা না থাকায় বিপাকে আছেন সেখানকার পর্যটননির্ভর মানুষ।

ইকোপার্কের ভেতরের ভ্রাম্যমাণ দোকানী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বেকার হয়ে গেছি। খুব কষ্টে আছি। গত বছর লকডাউন পরে জুমে (খাসিয়া পুঞ্জি) কাজ করছি। কোনোমতে চলতে পারছি। এবার কোনো কাজও নাই। মনে আশা লইয়া আই যদি খুলে দেওয়া হয়। দোকান আবার চালু করব। কবে খুলে দেওয়া হবে জানি না।’ তবে করোনা সংকট কেটে গেলে হয়তো আবার পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হবে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, এই আশা তাজুলের। তার মতো আরও অসংখ্য অস্থায়ী দোকানি এখন বেকার সময় পার করছেন। মাধবকুণ্ডে পর্যটকদের ছবি তুলে রোজগার করতেন প্রায় ১৫ জন আলোকচিত্রী। যারা বর্তমানে বেকার সময় পার করছেন।

আলোকচিত্রী মো. রহিম উদ্দিন বলেন, ‘মাধবকুণ্ড বন্ধ থাকায় খুব কষ্টে আছি। করুণ অবস্থা। পর্যটক না আইলে আমাদের রুজি বন্ধ। ঈদের সময় কিছু মানুষ আর (আসতেছে)। তারা চা বাগানে ছবি তুলছে। চা বাগানের এই ছবিগুলো তুলে পকেট খরচের (হাত খরচ) টাকা রোজগার করছি। ইকোপার্কের গেটম্যান সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ না থাকায় রাস্তাঘাট পিছলা (পিচ্ছিল) অই গেছে (হয়ে গেছে)। ভিতরে (ভেতরে) খুব সুন্দর লাগে। হামুক (শামুক) ঘুরে, বড় বড় পাড়ি (পাহাড়ি) কাঁকড়া দেখা যায়। বান্দর (বানর), বন মোরগ ইতাতো সচরাচর দেখা যায়। আগে মানুষ আইলে (আসলে) ইতা দেখা যাইত (যেত) না।’

জলপ্রপাতসংলগ্ন মাধবকুণ্ড আদিবাসী খাসিয়া পুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ওয়ানবর এল গিরি। তিনি এখানেই বড় হয়েছেন। ওয়ানবর এল গিরি বলেন, ‘লকডাউনে বন্ধ থাকায় মাধবকুণ্ডের পরিবেশ খুব সুন্দর লাগছে। আমরা ছোটবেলা যেরকম মাধবকুণ্ড দেখতাম। সেরকম লাগছে। বনমোরগ পাল পাল দেখা যায়। বানর তো গাছে গাছে ঘুরছে। ঝরনার কাছে শামুক ও পাহাড়ি কাঁকড়ার চলাফেরা করছে নিজেদের মতো। শান্ত একটা পরিবেশ বিরাজ করছে।’

বন বিভাগের বড়লেখা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস বলেন, ‘পর্যটকের আনাগোনা না থাকায় মাধবকুণ্ডের পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়েছে। প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যটনকেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে। ঈদের সময় অনেক লোকজন এসেছেন শুক্র ও শনিবারে। আমাদের লোকজন সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তারা আশপাশে ঘুরে ছবি তুলে ফিরে যাচ্ছেন।’

ইত্তেফাক/এমআর