বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আম এদেশের, পড়ে ভারতের মাটিতেও!

আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৩:৫৬

সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা কোহিনুর বেগম। আদি বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাট এলাকায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাবা-মাসহ নদীয়া জেলার বগলুতে আসেন তার ফুফুর বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেখান থেকে যোগাযোগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা যশোরের পুটখালীর ইছামতী নদীর পাড়ে গাতিপাড়া গ্রামে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে কোহিনুরের আর রানাঘাট এলাকায় যাওয়া হয়নি। তবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত তার বাবা-মা মাঝেমধ্যে গাতিপাড়া গ্রামে এসে দেখা করে যেতেন। বিয়ের পর থেকে কোহিনুরের কাছে গাতিপাড়া গ্রাম অন্য দেশের গ্রাম বলে মনে হতো না। শ্বশুরবাড়ির পাশেই যে বাড়ি, সেটি ভারতের তেরঘর গ্রামে পড়েছে। তেরঘরের মোটামুটি সবার বাড়িতেই যাতায়াত ছিল কোহিনুরের। কিন্তু ২০০৮ সালে তেরঘর ও গাতিপাড়া গ্রামের মধ্যে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা তোলা হয়। দুই গ্রামের পুরাতন বাঁশঝাড়ও সীমানাপ্রাচীরের কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। এদেশের আমবাগানের অনেক গাছের ফল পড়ছে এখন ভারতের তেরঘর গ্রামের মাটিতে! কেবল আম নয়, নারিকেল, বেল, কদবেল, বরইসহ পুরাতন গাছের গোড়া ঠিকই গাতিপাড়া গ্রামে। কিন্তু অন্য অংশ তেরঘর গ্রামে।

চৈত্রের দুপুরে বাড়ির হেঁসেলে বসে কোহিনুর এমন কথা জানালেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ওপারে বাঁশের বেড়ার সীমানাপ্রাচীর দেখা যায়। ওটাই ভারতের তেরঘর গ্রাম। কোহিনুর বলেন, ‘আগে ভাইবোনেরা আসত দেখা করতে। সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পর সব বন্ধ হয়ে গেছে। কত দিন ধরে নিজের ভাইবোনদের দেখি না। দেখার সুযোগও নেই।’

ইছামতী নদীর বাংলাদেশ পাড়ে ভারতের গ্রামটিতে ১৩টি পরিবার থাকত বলে এটাকে তেরঘর গ্রাম বলা হয়। আগে এই গ্রামের সবারই যাতায়াত ছিল যশোর এলাকায়। নৌকা বেয়ে ইছামতী নদী পেরিয়ে নদীয়া জেলা শহর প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ। এর চেয়ে তারা পুটখালী বাজার ও বেনাপোল বাজারে দৈনিন্দন চাহিদা মেটাতেন। তেরঘর গ্রামের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পর তারা এখন ইছামতী নদী পাড়ি দিয়ে নদীয়া ও বনগাঁয়ে যাতায়াত করেন।

গাতিপাড়ার কামাল উদ্দিন নামে এক বাসিন্দা বলেন, আগে তেরঘর গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে অবাধে শাড়ি, মূল্যবান কাপড়, মসলা, ফেনসিডিল, লবণ, চিনি এমনকি বিস্ফোরক উপাদান পর্যন্ত পাচার হতো। বছর তেরো আগে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। গাতিপাড়া গ্রামে বিজিবির একটি বিওপি স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে চোরাচালান বন্ধ হয়ে গেছে।

গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গাতিপাড়া গ্রামে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় গ্রামের শান্তা বেগমের। তার বাড়ির গোসলখানার পাশ দিয়ে বাঁশের বেড়ার সীমানাপ্রাচীর। বাড়ির প্রবেশগেটের ঠিক চার-পাঁচ হাত সামনেই তেরঘর গ্রাম। বাড়ির উঠানের সামনে আরেকটি দেশের গ্রাম ও তাদের চলাচল, কেমন লাগে জানতে চাইলে শান্তা বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ির অনেক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ইছামতী নদীর ওপারে ভারতের কালিয়ানী গ্রামে। এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে তাদের কখনোই আসতে দেখিনি। তবে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখ থেকে তাদের গল্প শুনেছি।’

গাতিপাড়া গ্রামের এক পাশ জুড়ে আমের বাগান। গাছে গাছে গুটি আম ঝুলে আছে। আরেক দিকে বাঁশঝাড়, যেটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে দুই ভাগ করা হয়েছে। এক অংশ পড়েছে বাংলাদেশে, অপরটি ভারতে। বাগানের আমগাছগুলো দেখিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সয়ের আলী বলেন, বাগানের আম নামানোর সময় কোনো সমস্যা হয় না। ওপারে আম পড়লে আমরাই গিয়ে নিয়ে আসি। ওরা কোনো ঝামেলা করে না। তবে ইছামতী নদীর ওপারে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে আমার তিন বিঘা জমি আছে। ওই জমিতে চাষাবাদ করতে পারি না ঝামেলার কারণে।

তেরঘর গ্রামে ১০-১২টি পাকা বাড়ি। এক বাড়ির খোলা গোসলখানায় কাপড় পরিষ্কার করছিলেন নারীরা। এক নারীকে ‘দিদি’ সম্বোধন করে বলা হলো, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। কেমন আছেন?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলছি এটা জানতে পারলে বিএসএফ এসে ঝামেলা করবে।’ বিজিবির বিওপিতে উপস্থিত জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানান, নোম্যান্স ল্যান্ড অতিক্রম করে বাংলাদেশের কেউ ওপারে যায় না। ওরাও কেউ আসে না।
ইত্তেফাক/এমএএম