বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গাছের মায়ায় কেটে গেল জীবনের ২২টি বছর

আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩:৪০

গাছের প্রতি অপরিসীম মায়া আর ভালোবাসায় কেটে গেছে তার জীবনের ২২টি বছর। গাছ শুধু প্রকৃতির অংশই নয়, জীবনেরও অনুষঙ্গ। আর সেই অনুষঙ্গ জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিলিয়ে নিয়েছেন বুলবুলি।

বুলবুলির বাড়ি হেমনগর ইউনিয়নের সোনাআটায়। বাবা মৃত জোয়াদ আলী। জানা যায়, যৌতুকের টাকা পরিশোধ না করায় বিয়ের চার বছরের মাথায় ঘর ভাঙে বুলবুলির। দুই সন্তান নিয়ে ওঠেন বাবার ভিটায়। ২০০০ সালে ফরেস্ট্রি সেক্টর প্রকল্পের টাকায় গোপালপুর-নলিন ১৮ কিলোমিটার সড়ক যৌথভাবে বনায়ন করে এলজিইডি ও এসডিআইপিকে। আকাশমনি, শিশু, ইউক্যালিপটাস ও অর্জুন চারার বনায়ন দেখভালের জন্য যে ১৮ জন বিত্তহীন নারীকে বাছাই করা হয়, বুলবুলি তাদেরই একজন। চুক্তি ছিল, টানা তিন বছর প্রত্যেকে মাসে তিন মণ গম ও নগদ ৫০০ টাকা ভাতা পাবেন। গাছ বড় হলে কাটার পর ৫ শতাংশ হিস্যা পাবেন।

সড়কের সোনাআটা পশ্চিম অংশের দায়িত্ব পাওয়া জুলেখা জানান, ছয় মাস গম ও ভাতা দেওয়ার পর ২০০২ সালে ভেগে যায় বেসরকারি সংস্থা এসডিআইপিকে। উপজেলা এলজিইডি তখন আশ্বস্ত করে, পাওনার ব্যবস্থা হবে। সেই আশায় টানা ১২ বছর গাছ পাহারা দেন বিত্তহীন নারীরা। গাছ ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠলে ভয়ভীতি দেখিয়ে কাটা শুরু করে দুর্বৃত্তরা। জনপ্রতিনিধি ও এলজিইডিকে অবহিত করে প্রতিকার না পেয়ে বুলবুলি ছাড়া সব নারীই গাছ পাহারা বন্ধ করে দেন।

সোনাআটার নজরুল ইসলাম জানান, দুর্বৃত্তদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বুলবুলি রাতের বেলা দা নিয়ে পাহারা শুরু করেন। গাছের প্রতি মায়া দেখে গ্রামের অনেকেই তাকে সহযোগিতা করেন। ফলে নবগ্রাম মোড় থেকে পূর্ব সোনাআটা সড়কে কিছু গাছ টিকে যায়।

বুলবুলি জানান, বিয়ের সময় দিনমজুর বাবা সড়ক বনায়নের সুফল দেখিয়ে তাকে বিয়ে দেন। কথা ছিল, গাছ পাহারার গম ও ভাতার পুরোটাই যৌতুক হিসেবে পাবেন স্বামী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এনজিও বকেয়া না দিয়ে লাপাত্তা হলে তার কপাল পোড়ে। ভাঙে সংসার। সন্তানদের কাউকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। বুলবুলি পাড়ায় ঝিঁয়ের কাজের ফাঁকে সড়কের গাছ এখনো দিনরাত দেখভাল করেন।

গাছের বেশির ভাগই অর্জুন। সড়কের উত্তরে বিশাল মাঠ। খরতাপ বা রোদবৃষ্টিতে কৃষকেরা এই অর্জুনের ছায়ায় বিশ্রাম নেন। সড়কের দক্ষিণের বড় বিলে হাজারো পাখির আনাগোনা। আশপাশে বড় গাছপালা না থাকায় পাখপাখালি অর্জুনগাছে বাসা বাঁধে। বাচ্চা ফোটায়। ভেষজ বৃক্ষ অর্জুনের ছাল-বাকল, কচি পাতা ও গুটি বনৌষধির দামি কাঁচামাল। মাদার ট্রি হিসেবে অর্জুনগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেন অনেকে। এসব গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয় না, ঝড়ঝাপটা থেকেও সুরক্ষা দেয়। বকেয়া পাওনা মেলেনি বলে আফসোস নেই বুলবুলির। গাছের ছায়া ও মায়াকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছেন। গাছ যে তার কাছে সন্তানের মতোই আপন। প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুয়ারা ময়না জানান, সরকার টাকা খরচ করে সড়ক বনায়ন করে শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, বিত্তহীন নারীদের এখানে অংশীদার করা হয় দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। নিজের সন্তানের মতোই আগলে রেখে অতিকষ্টে যারা ছোট্ট চারাকে বিশাল গাছে পরিণত করেন, সেই বুলবুলিরা বনায়নের সুফল পান না।

সাবেক ইউপি সদস্য আজাহার আলী জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও ভাতার টাকা ও গম মেরে দিয়েছে। এলজিইডি গাছ রক্ষা এমনকি বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। সবখানে গরিবেরাই ঠকে।

এ প্রসঙ্গে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, এসব তো অনেক আগের কথা। তাই বিশেষ কিছু জানেন না তিনি। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জার মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, স্ট্রিট প্লান্টেশনের হিস্যা বণ্টন এবং সার্বিক মনিটরিংয়ের দায়িত্ব এলজিইডির। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক বলেন, অনেক পুরনো বিষয়। তবে এখন কোথাও সড়কের গাছ চুরি গেলে উপজেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।

ইত্তেফাক/এমআর