বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৩০

 

আজ সেই ভয়াল ১২ই নভেম্বর। ৪৮ বছর আগের সেই দিনের বেদনা বিধুর ইতিহাস বাঙালী জাতি আজও ভুলতে পারেনি। ১৯৭০ সালের এই দিনে সমগ্র উপকূল জুড়ে বয়ে যায় মহা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে উপকুলের ১০ লক্ষাধিক নিরক্ষর মানুষের প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। ভেসে যায় গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঠ ফসল এবং অসংখ্য গাছপালা, পশু-পাখি। পুরো উপকূল মুহুর্তেই ধ্বংস যজ্ঞে পরিণত হয়। চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে লাশ আর লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ বাতাস। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস গোর্কী।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সে দিন ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বিকেলের দিকে বাতাস বাড়তে থাকে। রাতের দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রচার করতে থাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপটি হারিকেনের রূপ ধারণ করেছে এবং যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ২০-২৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, উপকূলের বঞ্চিত মানুষের কানে এ সতর্কবাণী পৌছেনি। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। সবাই বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের আত্মচিৎকারে সবাই জেগে ওঠে। বাইরে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তীব্র গতিতে জোয়ারের তোড়ে প্রথমে উঠোন, সঙ্গে সঙ্গে ঘর ডুবে আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। সবাই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত হন। ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ভাঙ্গার বিকট শব্দের সঙ্গে যুদ্ধংদেহী প্রকৃতির ভয়ংকর গর্জনে মনে হয়েছে যেন কেয়ামত বুঝি শুরু হয়ে গেল। মানুষের বেঁচে থাকার করুন আকুতি। কেউ ছনের চালায়, টিনের চালায়, কেউ গাছের মগডালে, কেউ হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করেছে। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের। জলোচ্ছ্বসের তোড়ে ভেসে গিয়ে মুহুর্তের মধ্যে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। শেষ রাতের দিকে মুহুর্তেই প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে পানি নেমে যায়। চতুর্দিকে ভেসে আসে মানুষের আর্তনাদ। সন্তান হারা মায়ের কান্না, মা হারা সন্তানের চিৎকার, ভাই হারা বোনের বুকফাটা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

১২ নভেম্বরের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বসে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। মনপুরার কোথাও বেড়ি বাঁধ কিংবা সাইক্লোন শেল্টার তখনও গড়ে ওঠেনি। গাছপালা তেমন একটা লম্বা বা মোটা ছিলনা। সাগর মোহনার ২৫-৩০ ফুট উচু ঢেউ ও জলোচ্ছ্বসে মনপুরার ৩০ সহস্রাধিক মানুষ ও গবাধি পশু সমুলে নিমিষেই স্রোতের টানে ভেসে গেছে উত্তাল সাগরে। প্রকৃতি শান্ত হলে দেখা যায়, গাছে গাছে ঝুলে আছে লাশ আর লাশ। যেখানে সেখানে লাশ আর লাশ। সাপ আর মানুষের একসাথে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টার নিদর্শন দেখে মানুষ যেমন হয়েছে আতংকিত তেমনি হয়েছে অভিভুত। মনপুরায় বেঁচে ছিল মাত্র ৮ হাজার স্বজন হারানো ব্যাথাতুর মানুষ।

ভোলার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড উপকূলীয় জনপদের বেদনার্ত কাহিনী ৫দিন পর রাজধানী জানতে পারে তৎকালীন দৈনিক পুর্বদেশ পত্রিকার মাধ্যমে। বর্তমানে ভোলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার কণ্ঠের সম্পাদক মোঃ হাবিবুর রহমান ছিলেন সেই সময়ের পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর সরকারের নজরে আসলে মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। মুহুর্তের মধ্যে প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে ম্যাচ, মোমবাতি, চিড়া, মুড়ি, শাড়ি, লুঙ্গি, গেন্জি,পান্জাবি, তেল, লবণ, খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট, সাবান, প্যান্ট শার্টসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যসামগ্রী। কিছুক্ষণ পরপর হেলিকপ্টারের হু হু শব্দ আর হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ফেলে যাওয়া আজও দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মনকে নাড়া দেয়। সেই দিনের আলোচনা উঠলে এখনো অনেকেই নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনপুরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিসেস শেলিনা আকতার চৌধুরী বলেন, সেই দিনের স্মৃতি আজো আমি ভুলতে পারিনি। আমার শ্বশুর বাড়ীতে দোতালা টিনের ঘর ছিল। প্রচণ্ড ঢেউ ও বাতাসের তীব্র গতিতে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকলে আশে পাশের এলাকার লোকজন ছুটে আসে আমাদের দোতালায় উঠে। অনেক লোকজনের আত্মনাদ সেই দিন শুনতে পেয়েছি। বাঁচার জন্য আকুতি। অনেক লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। আশ্রয় নেয় মানুষের পাশাপাশি সাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির হিংশ্র জীব জন্তু। পানি কমলে দেখতে পায় দোতালার একটি কক্ষে অনেক বিষধর সাপ। কিন্তু সেই দিন সেই সাপ কাউকে আঘাত করেনি। সেই দিন দেখেছি বিপদে বিষধর সাপ মানুষের বন্ধু হিসেবে পাশে থাকতে। আস্তে আস্তে তারা তাদের নিরাপদ স্থানে চলে যায়। 

মনপুরা উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আঃ লতিফ ভূঁইয়া বলেন, এদিন এলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। জোয়ারের প্রচণ্ড স্রোত এবং ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডব থেকে আমাকে বাঁচাতে মা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমাকে নিরাপদ স্থানে রেখে মা সেই যে জোয়ারের পানিতে ভেসে গেলেন আর পাইনি মাকে। সেই বন্যায় আমি আমার পরিবারের মা, বাবা ও বোনসহ ১৮ জনকে হারিয়েছি। সবাই তখন স্বজন হারা। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে ১০/১২ জনকে একসাথে মাটি দিতে হয়েছে। 

হাজীরহাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত ইউপি সদস্যা মফিজা খাতুন বলেন, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ও ঢেউয়ের মাঝে আমার কোল থেকে ৫ মাসের কন্যা সন্তানটি পড়ে গেলে তাকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আমাকে প্রচণ্ড স্রোতে বাড়ি থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে বেঁচে থাকার জন্য মরা গরুর লেজ ধরি। এই লেজ ধরা অবস্থায় বঙ্গোপসাগরে ৭ দিন ভাসতে থাকি। এরপর কক্সবাজার থেকে ৩শত মাইল দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে বহিরাগত একটি জাহাজ আমাকে তুলে চট্রগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। ১ মাস পর মনপুরায় ফিরে আসি।

হাজীরহাট বাজারের বিশিষ্ট পান ব্যাবসায়ী ইয়াছিন বেপারী দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, সেইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমি প্রতিদিনের মত নাইবের হাট বাজারে পান বিক্রি করতে যাই। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়। বিকাল বেলা আকাশ মেঘে ঢেকে ফেলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে পান বিক্রি বন্ধ করে বাড়ী চলে আসি। তখন রাত আনুমানিক ৯টা হবে। খাবার খেয়ে ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাত হঠাৎ দেখি ঘরের ভিতর পানি। জোয়ারের প্রচণ্ড গতি ও বাতাসের তীব্রতায় মুহুর্তের মধ্যে এক বুক পানি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে স্ত্রী , ২ ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে একটি গাছে উঠি। আমি আমার ছেলে হেলাল, বেলালকে ধরি এবং মেয়ে মহিমাকে তার মা নুরভানু ধরে। কিন্তু একদিকে বাতাস অন্যদিকে জোয়ারের তোড়ে শিশু সন্তানদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে আজও কান্না ধরে রাখতে পারিনা বলে চোখের এক কোনা থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে তার। 

১২ নভেম্বরে স্বজনদের মৃত্যুকে স্মরণ করে আজও বিভিন্ন সংগঠন মসজিদ ও মন্দিরে দোয়া, মিলাদ ও বিশেষ প্রার্থনা করে। আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য শোকের দিন। উপকূলবাসী উপকূল দিবস হিসেবে এই দিনটি পালন করার জন্য দাবী জানিয়ে আসছেন।

ইত্তেফাক/আরকেজি