বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় বাড়ছে কিশোর অপরাধ

আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২০, ১৫:৩৯

নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাংদের তাণ্ডব কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। পরিবারের লোকজনদের আশকারায় বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করেছে এসব গ্যাং। সর্বশেষ তাদের তাণ্ডবে প্রাণ গেছে বন্দরের দুইজন শিক্ষার্থীর। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক সচেতনতার অভাবেই এসব গ্যাংয়ের সৃষ্টি। তারাই মূলত নানা ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। নাম না প্রকাশের শর্তে কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য জানায়, স্থানীয় প্রভাবশালী ও নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাং মূলত বেপরোয়া হয়ে উঠে। কারণ একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রাথমিকভাবে বড় বড় অপকর্ম করার সাহস থাকে না। কিন্তু প্রভাবশালী নেতারা যখন তাদের কাজকর্ম করার জন্য গ্যাংদের শেল্টার দিয়ে থাকে। তখন সেসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ধীরে ধীরে বেপরোয়া ওয়ে উঠে। আর এভাবে গ্যাংগুলো মারাত্মক অপকর্ম করে থাকে। 

সর্বশেষ গত সোমবার বন্দরের ইস্পাহানী ঘাট এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে ধাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেওয়া দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের একজন মিহাদ (১৮) বন্দরের কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্র। সে নাজিমউদ্দিন খানের ছেলে ও বন্দর প্রেসক্লাবের সভাপতি কমল খানের ভাতিজা। অপরজন হলো, বন্দরের বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জিসান (১৫)। সে বন্দর প্রেসক্লাবের সাবেক সেক্রেটারি কাজিমউদ্দিনের ছেলে। গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ওই ঘটনা ঘটে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ইস্পাহানী ঘাট এলাকায় গত সোমবার বিকেলে স্থানীয় দুই গ্রুপ কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এসময় একপক্ষের ধাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় মিহাদ ও জিসান। এদিকে মিহাদ ও জিসান নদী থেকে উঠে গেছে এমনটি ভেবে স্থানীয় লোকজন তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে রাতে তারা বাড়িতে ফিরে না যাওয়ায় স্বজনরা খোঁজাখুঁজি শুরু করলে জানতে পারে সংঘর্ষ ও ধাওয়ার ঘটনায় তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। এসময় তাদের খোঁজে শীতলক্ষ্যার তীরে বাড়তে শুরু করে জনসমাগম। রাত পৌনে ১২টায় দুইজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৪ আগস্ট ফতুল্লার গাবতলীতে একটি ঘটনা ঘটে। সেদিন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় মাঠ কাঁপানো তুখোড় সাবেক ফুটবলার গোলাম গাউসের ছেলে ওয়াসিফ গাউসিল উৎস বড় একটি ছোরা নিয়ে একটি গলি থেকে উত্তেজিত অবস্থায় বের হয়ে আসে। সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন। কয়েক মিনিট পর আবারও উৎস সহযোগীদের সাথে নিয়ে সেই গলিতে প্রবেশ করে। কাউকে ধাওয়া করার জন্যই মূলত ওই অবস্থান নেয় উৎস।

আরও পড়ুন: দীর্ঘ ৫ মাস পর শারীরিক উপস্থিতিতে হাইকোর্টে বিচার কার্যক্রম শুরু

জানা গেছে, গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি উৎসকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ৪ আগস্ট ওই ঘটনার পর নিজামের মা নূরজাহান বেগম ফতুল্লা মডেল থানায় অভিযোগ দেন। 

এতে তিনি অভিযোগ করেন, উৎস তার বাবা গোলাম গাউস ও চাচা গোলাম সারোয়ার সহযোগী ১০ থেকে ১৫ জন নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ৪ আগস্ট নিজামকে ধাওয়া করে। এ সময়ে প্রতিপক্ষের কাছে দেশীয় অস্ত্র ছিল। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহরের চাষাঢ়ায় রেলস্টেশন সংলগ্ন সড়কে এ ঘটনা ঘটে। রফিকুল ইসলাম জীবন ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের জেলা প্রতিনিধি ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক। ঘটনার পর তিনি বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় জিডিটি দায়ের করেন। 

জিডিতে অভিযোগ করা হয়, কলেজ রোডের রুপক স্যারের ব্যাচ থেকে কোচিং করে বাসায় ফেরার পথে হামিমকে চাষাঢ়ায় ডাকবাংলোর বিপরীতে সড়কে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১০-১২ জন সন্ত্রাসী পথরোধ করে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করে। পরে হামিম ডাকবাংলোর মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয়। সেখানেও ওই হামলাকারী সন্ত্রাসীরা এসে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর আগে ফতুল্লায় অস্ত্র ও গুলিসহ নারী পোশাক শ্রমিকদের নিয়মিত উত্যক্তকারী গ্যাংস্টার গ্রুপের ৫ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-১১। 

গত বছরের ৬ নভেম্বর দুপুরে এ তথ্য জানান র‌্যাব ১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন। তাদের দেহ তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ১২ রাউন্ড পিস্তলের গুলি ও ৫টি রামদা। ২৪ অক্টোবর র‌্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল ফতুল্লা থানাধীন উত্তর ইসদাইর গাবতলী এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে নারীদের উত্ত্যক্তকারী গ্যাংস্টার গ্রুপের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। ২০ অক্টোবর ফতুল্লা থানার ইসদাইরের কিশোর গ্যাং লিডার হিসাবে পরিচিত ত্রাস ইভনকে এক দিনের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। স্থানীয় কিশোর ফারদিনকে নির্যাতন ও ছুরিকাঘাতে আহত করার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় ১৯ অক্টোবর বিকেলে ইভনকে গ্রেফতার করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। কিশোর গ্যাংদের নৃশংস হামলায় অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। 

গত ৩ অক্টোবর পূর্ব শত্রুতার জের ধরে দুই শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে মোবাইল সেট ও গলার চেইন ছিনিয়ে নিয়েছে বন্দরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। ৪ আগস্ট বন্দরের অলিপুরা কবরস্থান এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক নামের এক যুবককে পিটিয়ে ও গলাকেটে হত্যার চেষ্টা করে তিন কিশোর। 

২৩ আগস্ট ফতুল্লার বাবুরাইলে সালেমান হোসেন অপু (৩০) নামের যুবককে বাড়ি হতে ডেকে এনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আসামি পারভেজ (২৮)। 

এরপর ২৭ জুলাই ফতুল্লার দেওভোগ হাশেম নগর এলাকায় মোটরসাইকেলের লাইটের আলো চোখে পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাকিলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৩১ জুলাই ফয়সাল (১৯) নামে কিশোর শহরের খানপুর বরফকল এলাকায় বান্ধবীর মোবাইল ফিরিয়ে দিতে গেলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে ৫ কিশোর। ২২ আগস্ট গোলাকান্দাইল এলাকায় সন্ত্রাসীরা জিসান হোসেনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হলে পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। এভাবে চলছে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ। পরিবারের অসচেতনতা ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টারে বেড়েই চলেছে কিশোর অপরাধ। 

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, কিশোর অপরাধীরা যতবড় রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টারেই থাকুক তা ছাড় দেওয়া হবে না। অচিরেই জেলাব্যাপী সাড়াশি অভিযান চালানো হবে। কিশোর অপরাধীদের প্রতিহত করতে পুলিশ মাঠে নেমে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা কাউকে ছাড় দেব না।

ইত্তেফাক/এএএম