শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জিন মসজিদের কথা

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২০, ০১:৫৪

পবিত্র কুরআনের একটি সুরার নাম ‘জিন’। পবিত্র কাবাঘরের অদূরে অবস্থিত ‘মসজিদে জিন’, এখানেই জিনেরা প্রিয়নবি (স)-এর কণ্ঠে পবিত্র কুরআন শোনে এবং তার প্রতি ইমান আনে। হযরত সুলাইমান (আ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণে জিনদের কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও জিন মসজিদের অস্তিত্ব ও খ্যাতির অনুসন্ধান মেলে।

যেমন—লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার দেনায়েতপুর গ্রামে অবস্থিত মসজিদ-ই-জামে’ আবদুল্লাহ্। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেড় শ বছর আগে শত শত জিন মিলে রাতারাতি মসজিদটি তৈরি করে। যদিও মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় ধর্মপ্রাণগণ মসজিদ তৈরিবিষয়ক জনশ্রুতি বিশ্বাস করেন না। বরং ঐ এলাকার প্রখ্যাত আলিম মাওলানা আব্দুল্লাহ্ (রহ) ভারতের দেওবন্দে উচ্চশিক্ষা লাভের পর দেশে ফিরে ১৮৮৮ সালে দিল্লির শাহি মসজিদের আদলে মসজিদটি তৈরি করেন। 

১১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭০ ফুট প্রস্থ এই মসজিদে ৩টি গম্বুজ ও ৪টি মিনার রয়েছে। প্রতি কাতারে ৮৫ জন বা ছয় কাতারে পাঁচ শতাধিক মুসল্লি মসজিদটিতে নামাজ আদায় করতে পারেন। সমতলভূমি থেকে মসজিদটি বেশ উঁচুতে অবস্থিত, ১৩ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। অপর এক পাশের সিঁড়ি মসজিদের নিচের দিকে নেমে গেছে ২০ ফুট গভীরে, সেখানে রয়েছে একটি ইবাদতখানা। 

মাওলানা আব্দুল্লাহ্ (রহ) সেখানেই আধ্যাত্ম সাধনায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এখন অবশ্য সেখানে পানি জমে থাকে। মসজিদের পাশেই আছে কওমি মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা ও বিশাল দিঘি।

অন্যদিকে, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় যাওয়ার পথে ভুল্লি-পাঁচপীর হাট সড়কের পাশে অবস্থিত ছোট বালিয়া জামে মসজিদ। রূপকথা অনুযায়ী, কোনো এক অমাবস্যার রাতে জিন-পরিরা ঐ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি তাদের পছন্দ হলে তারা মাটিতে নেমে আসে এবং মসজিদ তৈরি শুরু করে। কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই সকাল হয়ে গেলে কাজ শেষ না করেই ওরা চলে যায়। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে যায় অসাধারণ একটি মসজিদ! 

স্থানীয়দের কাছে এ জন্যই ছোট বালিয়া জামে মসজিদ স্বীকৃত হয় জিনের মসজিদ হিসেবে। তবে ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় জমিদার মেহের বকস চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বালিয়া মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। শীলালিপি অনুসারে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৩১৭ বঙ্গাব্দ বা ১৯১০ সাল। 

কথিত আছে, জমিদার মেহের বকস চৌধুরী দিল্লির আগ্রা ও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি নিয়ে আসেন। মোগল স্থাপত্যশৈলীর জটিল নকশার মসজিদটি নির্মাণ যেমন ছিল ব্যয়বহুল, তেমনি সময়সাপেক্ষ। মসজিদ নির্মাণ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রধান স্থপতি মারা গেলে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। জমিদার মেহের বকস স্থানীয় কারিগর দিয়ে মসজিদের কাজ শুরু করলেও তারা মসজিদের গম্বুজ বানাতে পারেনি। 

অন্যদিকে মেহের বকসও ১৩১৭ বঙ্গাব্দ বা ১৯১০ সালে মারা যান। পরে মেহের বকসের ছোট ভাই মসজিদের কাজে হাত দেন, তিনিও মসজিদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান। ফলে গম্বুজবিহীনভাবেই মসজিদের ১০০ বছর পেরিয়ে যায়। তবে ২০১০ সালে মেহের বকসের প্রপৌত্রী তসরিফা খাতুনের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের সহায়তায় গম্বুজসহ মসজিদের নির্মাণ ও সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন তিন নেতার মাজারের পাশের হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদ অবস্থিত। অভিজাত ব্যবসায়ী হাজি শাহবাজ কাশ্মিরি ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে বসতি গড়েন। জনশ্রুতি আছে, খাজা শাহবাজ টঙ্গী থেকে এসে জিনদের নিয়ে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। এ জন্যই খাজা শাহবাজ মসজিদকে জিন মসজিদ বলা হয়। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৬৮ ও প্রস্থে ২৬ ফুট। মিম্বর কালো পাথরের, বাইরের রং লাল। 

মসজিদটিকে প্রত্নসম্পদ ঘোষণা করা হয়েছে। মোগল স্থাপত্যশৈলীর খাজা শাহবাজ মসজিদ ঢাকার ৩৩৮ বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। বাংলাপিডিয়ার বর্ণনায় রয়েছে, শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সুবাহ্দারির সময়ে হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদ বা এই জিন মসজিদ নির্মিত। বস্তুত, বাংলাদেশের জ্বিন মসজিদগুলো জাতীয় ঐতিহ্য ও মুসলিম স্থাপত্যকলার অংশ।

লেখক :ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর

ইত্তেফাক/জেডএইচ