বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রংপুরে পুলিশ সদস্যের নেতৃত্বে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩

আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২০, ১৯:২৩

রংপুর মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের এএসআই রায়হানুল হকের নেতৃত্বে নগরীর হারাগাছ থানার ক্যাদারের পুল এলাকায় একটি বাড়িতে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ডেকে এনে গণধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় আরপিএমপি কমিশনার অভিযুক্ত এএসআইকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। এ ঘটনায় আরও দুই নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

পিবিআই ও নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রীর পরিবার সূত্র জানায়, রংপুর মহানগরীর হারাগাছ থানার ময়নাকুঠি কচুটারি এলাকার নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের এএস আই রায়হানুল ইসলাম। তিনি আগে হারাগাছ থানার এএসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিচয়ের সময় রায়হান তার ডাক নাম রাজু বলে জানায় ওই ছাত্রীকে। সম্পর্কের সূত্র ধরে রবিবার সকালে ওই ছাত্রীকে রায়হান ডেকে নেয় নগরীর ক্যাদারের পুল এলাকার শহিদুল্লাহ মিয়ার ভাড়াটিয়া সুমাইয়ার পারভীন ওরফে মেঘলা ওরফে আলেয়ার বাড়িতে। সেখানে প্রথমে রায়হান ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। পরে আরও কয়েকজন পরিচিত যুবককে অর্থের বিনিময়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করায়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে বের হয়ে প্রথমে কোতয়ালী থানায় গিয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানায়। রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ ওই ছাত্রীকে নিয়ে ঘটনাস্থল বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সুমাইয়ার পারভীন মেঘলা ও  সম্পা বেগমসহ থানায় নিয়ে যায়। খবর দেওয়া হয় পরিবারকে। এরই মধ্যে ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত এএসআই রায়হানুলকে বাঁচাতে টাকার দেন-দরবার চলে থানা এলাকায়। বিষয়টি অবহিত হয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সেখানে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা পাঠান। তার হস্তক্ষেপেই ছাত্রীর পিতা আয়নাল বাদী হয়ে পুলিশ সদস্য রায়হান ও মেঘলাসহ অজ্ঞাত ২জনসহ অন্যান্য অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের নামে ধর্ষণ মামলা করেন। রাত পৌনে ১২ টায় পুলিশ অসুস্থ ছাত্রীকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১৩ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করায় পুলিশ। সকালে তাকে হাসপাতালের ওসিসিতে নেওয়া হয়। সেখানে তার ডাক্তারি পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। 

ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর মা জানান, মামলার আসামি ধরতে গিয়ে আমার মেয়ের সাথে পরিচয় এএসআই রায়হানুলের। তার পর থেকেই তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার মেয়ের তার সাথে কথাবার্তা বলতো। কিন্তু সে যে আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে এভাবে নির্যাতন করবে সেটা মেনে নিতে পারছি না। আমার মেয়ে ময়নাকুঠি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। সে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এখন আমার মেয়ের জীবন ধংসকারী রায়হানুল ও জড়িত অন্যান্যদের গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ড চাই। 

সচেতন নাগরিক কমিটি সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, পুলিশের যে এএসআই ঘটনার মূল নায়ক। তাকে ২ নম্বর আসামি করার প্রমাণিত হয় থানা পুলিশ প্রথমে রায়হানুলকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। এজহারে সেভাবেই উল্লেখও আছে। কোনভাবেই যেন এই পুলিশ সদস্য পার পেয়ে না যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে পুলিশ। এছাড়াও তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যেই মামলাটি পিবিআইয়ে হস্তান্তর করায় আরপিএমপি পুলিশ কমিশনার আব্দুল আলিম মাহমুদকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রমে পুলিশের প্রভাব থাকবে না বলে আমরা মনে করি। এছাড়াও তিনি এ ঘটানর দ্রুত ট্রাইবুনালে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার দাবি জানান। 

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আব্দুল আলীম মাহমুদ জানিয়েছেন, যেহেতু ঘটনাটিতে মেট্রো ডিবি পুলিশের একজন এ এসআই এজহারভূক্ত আসামি। সেকারণে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু তদন্তের জন্যই হারাগাছ থানা থেকে মামলাটি তদন্তের ভার আমরা পিবিআইকে দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেতে চাই। 

আরও পড়ুন: স্টাইলের সাথে স্মার্ট লাইফ উপহার দিবে হুয়াওয়ে ওয়াচ ফিট

তিনি বলেন, এ এসআই রায়হানুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাকে আটক করে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করে রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী হওয়ায় যেসব প্রসিডিউর করা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে। পিবিআই চাওয়া মাত্রই আমরা রায়হানুলকে তাদের কাছে হস্তান্তর করবো। 
তিনি আরও বলেন, অপরাধী অপরাধীই। তার কোন পরিচয় নেই। ঘটনাটি জানা মাত্রই আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জবানবন্দি নিয়ে মামলা নিয়েছি। এখানে কেউই পার পাবে না। 

পিবিআই রংপুর জেলার পুলিশ সুপার জাকির হোসেন জানান, দুপুরের পর আরপিএমপি থেকে আমরা মামলাটির তদন্তভার পাই। পাওয়া মাত্রই আমরা হাসপাতালের ওসিসিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রীর জবানবন্দি রেকর্ড করি। এছাড়াও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া ঘটনার তথ্য উপাথ্য ও নথিপত্র নিয়ে আমরা প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। 

তিনি বলেন, হারাগাছ থানা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টায় আমাদের কাছে গ্রেফতার মামলার ১ নম্বর আসামি সুমাইয়া পারভীন মেঘলা(২২) ও অপর সহযোগী সম্পাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা সেখান থেকে নিয়ে এসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। এছাড়াও পুলিশ লাইনে ক্লোজড অবস্থায় আছেন এএসআই রায়হানুল। আমরা যথাসময়ে তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে নিবো। 

তিনি বলেন, আমরা রায়হানের ডিএনএন পরীক্ষা করে তা ম্যাচিং করাবো। এ ঘটনায় কোন অভিযুক্তই কোনভাবে ছাড় পাবে না। এটি নিশ্চয়তা আমরা দিতে চাই। 

এদিকে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তার প্রয়োজনীয় ডাক্তারি পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। 

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি(অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন জানান, হারাগাছ থানাধীন ওই ছাত্রী গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের এএসআই রায়হানুল ইসলাম ওরফে (রাজুকে) সাসপেক্ট করা হয়েছে। রায়হান ওই মামলার দুই নং এজহারভুক্ত আসামি। সে এখন আমাদের হেফাজতে আটক অবস্থায় আছে। বেশ কিছু বিষয় আছে যেগুলো মেইনটেইন করার পরই তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কেউই ছাড়া পাবে না। 

এদিকে এ ঘটনায় নিবিড় তদন্ত শুরু করেছে পিবিআই। তদন্ত সূত্রগুলো বলছে, ডিবিতে আসার আগে এএসআই রায়হান হারাগাছ থানায় কর্মরত ছিলেন। তদন্তে এএসআই রায়হানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে মেয়ে নিয়ে গিয়ে দেহ ব্যবসাসহ তিনি হারাগাছ থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তার বিশেষ সখ্যতা থাকার অভিযোগের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে রংপুরে পুলিশের এএসআইয়ের নেতৃত্বে স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের তীব্র নিন্দা, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাসদ (মার্কসবাদী), নারীমুক্তি কেন্দ্র ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট রংপুর জেলা শাখা। 

সোমবার সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক প্রেস বার্তায় বলেন,রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এএসআই রায়হানুল ইসলাম রাজুর নেতৃত্বে মহানগরীর হারাগাছ থানার ময়নাকুঠি কাচুটারী এলাকার নবম শ্রেণির ছাত্রী গণধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন বাসদ (মার্কসবাদী) রংপুর জেলা সমন্বয়ক কমরেড আনোয়ার হোসেন বাবলু, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র রংপুর জেলার দপ্তর সম্পাদক কামরু ন্নাহার খানম শিখা এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, রংপুর মহানগরীর আহ্বায়ক সাজু রায়। 

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, সারাদেশ যখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ঠিক সেই সময়ে প্রশাসনের লোকের দ্বারা এ ধরণের অপরাধ সংঘটিত হওয়া অত্যন্ত বিস্ময়ের। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব, তারাই যদি এমন অপরাধ করে, তাহলে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে? তাই অবিলম্বে ধর্ষকদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রশাসনের লোক হওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই এএসআইকে যেন বাঁচানোর চেষ্টা না করা হয়। নেতৃবৃন্দ সর্বস্তরের বিবেকবান, ধর্ষণবিরোধী ও গণতন্ত্রমনা মানুষকে প্রতিবাদে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 

ইত্তেফাক/এএএম