শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার কারণে এবার প্রেমতলীর খেতুরীধামে ভক্তদের মহাসমাবেশ হচ্ছে না

আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২০, ১২:১০

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলীর খেতুরীধামে শ্রী শ্রী নরোত্তোম ঠাকুরের তিরোভাব তিথি উপলক্ষে প্রায় পাঁচ শতাব্দির ইতিহাস সমৃদ্ধ ভক্তদের মহাসমাবেশ বাতিল করা হয়েছে। আগামী ৪-৬ নভেম্বর তিনদিনের এই মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানের তারিখ পূর্বনির্ধারিত ছিল।

যুগ যুগ ধরে দুর্গাপূজার পর কার্তিকের পঞ্চমী তিথিতে সনাতন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা অহিংসার মহান সাধক ঠাকুর শ্রী শ্রী নরোত্তম দাসের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে মিলিত হন। এ মহোৎসবে দেশ-বিদেশের প্রায় ২০ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী হাড়ি, পোটলা, থালা-বাসনসহ নিত্য সামগ্রী নিয়ে এসে অংশ নেন। তবে এবার করোনা (কোভিড-১৯) মহামারীর কারণে ভক্তদের এই মহাসমাবেশ বাতিল করা হয়েছে।

বুধবার (২৮ অক্টোবর) বেলা ১১টায় স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ড আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন এ তথ্য জানানো হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ড. মদন মোহন দে বলেন, ‘প্রতিবছর কার্তিকের পঞ্চমী তিথিতে প্রেমভক্তি মহারাজ ঠাকুর শ্রী নরোত্তম দাস মহাশয়ের তিরোভাব তিথি মহোৎসব পালিত হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ ঝুঁকির কারণে আগামী ৪ থেকে ৬ নভেম্বর গোদাগাড়ীর খেতুরীধামে এবার ভক্ত সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, কয়েক লাখ ভক্তদের সমাগম হলে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে চাই না, আবার কারও অকাল মৃত্যুও চাই না। মহোৎসব হওয়ার পর এলাকাবাসীর যদি কারও করোনা সংক্রমণ দেখা দেয় তাহলে তার জন্য আমাদের দিকেই আঙ্গুল তোলার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না। আবেগ-তাড়িত না হয়ে জীবন রক্ষা করাই বড় ধর্ম। জীবন থাকলে ধর্মকর্ম এবং ভজন সাধন করা যাবে। তাই যতদিন পর্যন্ত করোনা ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষের মানুষের নাগালে না পৌঁছাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমরা আবেগ-তাড়িত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভক্ত সমাগম না ঘটানোর পক্ষে। এলাকাবাসী এবং দেশবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মন্দিরের ফটক বন্ধ করে হরিনাম সংকীর্ত্তনসহ ধর্মীয় পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হবে। নাগমন্দিরে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী কীর্তনও হবে। এতে চারটি দল অংশ নেবে। প্রতি দলে থাকবেন মাত্র ১০ জন। তাদের রান্নার থাকবেন ১০ জন। এছাড়া ট্রাস্ট বোর্ডের ১২ সদস্য এবং অন্য ছয়জন কর্মী মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬০/৬৫ জনের মতো থাকবেন। এর বাইরে একজনও থাকার সুযোগ পাবেন না। মন্দিরের ফটক এমনকি খেতুরীধামে প্রবেশের সকল রাস্তাও বন্ধ রাখা হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে ট্রাস্ট বোর্ডের কথা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন নির্ধারিত সময় খেতুরীধামের দিকে কোন ভক্তকে যেতে দেবে না। মহাসড়কে বাস এলে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। ‘মূল মন্দিরের বাইরে কোন প্যান্ডেল, অস্থায়ী দোকানপাট বা অন্যান্য অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা যাবে না। তাই ট্রাস্ট বোর্ডের পক্ষ থেকে ভক্তদের এবার খেতুরী ধামে না আসার জন্য অনুরোধ জানানো

সংবাদ সম্মেলনে শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপদ স্যানাল, সদস্য সুনন্দন দাস রতন, বাবু মণ্ডল, গণেশ চন্দ্র ঘোষ, বিকাশ কুমার সরকার, ব্যবস্থাপক গোবিন্দ চন্দ্র পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বর্তমান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা তীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব পার করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি খেতুরে ফিরে আসেন। খেতুর মন্দিরে গড়ে তোলেন স্থাপনা। এরপর তিনিই প্রথমে এখানে এ উৎসবের আয়োজন করেন। ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকের পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নৃত্যলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। শিষ্যরা তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন তার দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য তার দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ এক সময় সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। এরপর থেকেই দুর্গাপূজার পর কার্তিকের পঞ্চমী তিথিতে বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধকের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন। এটি হয়ে থাকে বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ।

ইত্তেফাক/এমআরএম