শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মরা নদীর বুকে ফের থইথই পানি

আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০১

মরা নদীর বুকে আবারও জল থইথই করছে। শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে এক ফোটা পানি মিলত না। নদীটি মিশে গিয়েছিল সমতলের ফসলি জমির সঙ্গে। সেখানে ফলত ফসল। কিন্তু গত বছর নদীটির ১০ কিলোমিটার পুনঃখনন করায় পালটে গেছে সেই চিত্র। এখানে বলা হচ্ছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ভেরসা নদীর কথা।

তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভেরসা নদী তো মরেই গিয়েছিল। নদীর কোনো চিহ্ন ছিল না। ফসলি জমির সমান হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে আমরা সেচ দিয়ে ধান চাষ করতাম। এখন নদীটি আবার খনন করে দেওয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’

খননের পর এখন নদীতে বারো মাস মিলছে দুকূল ভরা পানি। নদীর চারপাশের ফসলি জমি পাচ্ছে সেচ সুবিধা। শুধু ভেরসা নয় পঞ্চগড়ের আরো চারটি নদী ও একটি খাল পুনঃখনন করার পর দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পুনঃখননের পর পঞ্চগড়ের মৃতপ্রায় নদী ও খালে ফিরেছে প্রাণ। নদী ও খাল খনন হওয়ায় জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি ফসল ও দেশি মাছের উত্পাদন বৃদ্ধিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত রক্ষা পেয়েছে। নদীবেষ্টিত এলাকার মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক ব্যবহার ও সুবিধার আওতায় এসেছে।

আরও পড়ুন: নদীর ভাঙন রোধে নতুন কৌশল উদ্ভাবন

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশের নদ-নদী ও পরিবেশ রক্ষায় সরকার শতবর্ষী ডেলটা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভেরসা, চাওয়াই, পঞ্চগড় সদর উপজেলার করতোয়া, দেবীগঞ্জ উপজেলার বুড়িতিস্তা ও বোদা উপজেলার পাথরাজ নদী এবং আটোয়ারী উপজেলার বড়সিংগিয়া খাল খনন করে। এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাওয়াই নদী ২০ কিলোমিটার, তেঁতুলিয়ার ভেরসা নদীর ১০ কিলোমিটার, দেবীগঞ্জ উপজেলার বুড়িতিস্তা ২০ কিলোমিটার, বোদা উপজেলার পাথরাজ নদী ৩০ কিলোমিটার, করতোয়া নদী ৩০ কিলোমিটার খনন হয়েছে এবং আটোয়ারী উপজেলার বড়সিংগিয়া খাল ছয় কিলোমিটার।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানি সম্পদের সুষম ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের জীবন ও জীবিকার জন্য পানির চাহিদা পূরণ এবং টেকসই উন্নয়ন, পুনঃখননের মাধ্যমে ছোট নদী, খাল ও জলাশয়গুলো পুনরুজ্জীবিত করা, ছোট নদী, খাল এবং জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা, পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে মত্স্য চাষের উন্নয়ন করা, নদীগুলোর উভয় তীরে বনায়ন করা, খননকৃত মাটি দ্বারা উভয় তীরের ভূমি উন্নয়ন, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন করার লক্ষ্যে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব নদী ও খাল খনন করা হয়েছে।

পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম জানান, ডেলটা প্ল্যানের আওতায় নদী খনন প্রকল্পে পঞ্চগড় জেলায় ১৬৪ কিলোমিটার নদী পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এরই মধ্যে প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার পাঁচটি নদী ও একটি খালের ৬৬ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। নদীগুলোর ২০ মিটার প্রশস্ত এবং ছয় ফিট গভীর করে খনন করা হয়েছে। খননের ফলে নদী ও খালের হারিয়ে যাওয়া পানির প্রবাহ ফিরেছে। এছাড়া নদী ও খালের উভয় পাড়ে বনায়নের জন্য বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া লোক চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে অন্যান্য খাল খননের কাজও আমরা চলমান রেখেছি।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ‘ডেলটা প্ল্যান ২১০০’ অনুমোদন করে, যার প্রথম ১০ বছর ২০২০-৩০ সালের মধ্যে ৮০টি প্রকল্পে ৩৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। প্রস্তাবিত ৮০টি প্রকল্পে এই টাকা খরচ করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে আশা করা যায়। নেদারল্যান্ডস সরকার ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুরোধে ‘ডেলটা প্ল্যান ২১০০’ প্রণয়ন শুরু করে।

আরও পড়ুন: পায়ে হেঁটে তিস্তা পারাপার!

পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি নদী ও একটি খাল খননের ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর পানি ব্যবহার করে শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফল ও ফসলের চাষাবাদ বেড়েছে। নদীর নাব্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী খনন বাস্তবায়নের ফলে ছোট নদী ও খালগুলোতে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বছরব্যাপী সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি উত্পাদন বেড়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি উপজেলায় নদী ও খাল খননের ফলে জেলায় হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। বর্ষায় পানি নিষ্কাশন ও শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য পানির নিশ্চয়তা নিশ্চিত হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের কারণে বেড়েছে সংশ্লি­ষ্ট এলাকার সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের উত্পাদন। এক ফসলি জমি দুই-তিন ফসলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত ফসল উত্পাদন সম্ভব হচ্ছে।

জেলার বোদা উপজেলার কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দীন আলাল জানান, নদীগুলো পুনঃখনন করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার একর জমিতে শাকসবজি, ফল, বোরো ও আমন ফসল উত্পাদনের আওতায় এসেছে। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পরিবেশবিদ তৌহিদুল বারী বাবু জানান, নদী ও খাল খননের ফলে নদী, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সহজতর হয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া বা মরে যাওয়া অন্য নদী ও খালগুলো খনন করা হলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের আসল রূপ ফুটে ওঠবে।


ইত্তেফাক/এমএএম