শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষার আলো ছড়াতে সালেহা বেগমের সংগ্রাম

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১৬:১২

স্বপ্নজয়ী নারী সালেহা বেগমের জন্ম এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। আর্থিক সংকটের কারণে মকতবে পড়া অবস্থায় নিজ জন্মস্থান ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সাগরপাড়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরমোন্তাজ ইউনিয়নের মধ্য চরমোন্তাজ গ্রামে আসেন।

এসেই মহাসংকটে পড়েন সালেহা বেগম। সেখানে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাও বাড়ি থেকে অনেক দূরে। দূরত্বের কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। 

এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা স্বশিক্ষিত সালেহা বেগম চেয়েছিলেন, বদল আসুক। শিক্ষার ভিতটা যে মজবুত হওয়া দরকার, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে ৩৮ বছর আগে নিজের বাড়িতে ১৯৮৬ সালে নিজের ঘরে পাঠশালা খুলে গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিজেই পড়াতেন। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে গেলে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে চার বছর পর ১৯৯০ সালে তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্বপ্নকে পুঁজি করে স্কুলটি ২০১৩ সালে ‘মধ্য চরমোন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে জাতীয়করণে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

৭৫ বছর বয়সের সালেহা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন। বলছিলেন, ১৯৮৬ সালে নিজেদের শরীফ বাড়িতেই পাঠশালা খোলেন। সিলেবাস মেনে প্রথাগত পড়াশোনা না হলেও বাংলা, অংকসহ আরও বেশ কিছু বিষয় শেখানো হতো সেই স্কুলে। বেশির ভাগটাই শেখাতেন তিনি নিজে। আস্তে আস্তে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ালেখার ঝোক চাপে। দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়িতে তাদের সংকুলান হচ্ছিল না। 

এরই মধ্যে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবেশিদের (পুরুষ) উদ্ভুদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হল। কিন্তু সমালোচনার কারনে উদ্যোগ ভেস্তে গেল। তবে গ্রামের ১৫ জন নারী আর হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষ সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তাদের সহযোগিতায় সাগরতীরের একখণ্ড খাস জমিতে ১৯৯০ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন সালেহা বেগম। নিজেদের গরুঘরের চাল, খড় (নাড়া), খুঁটি, খাজুর খাছের পাতা দিয়ে এক কক্ষের ঘর তোলা হয়। কলাগাছের পাতা দিয়ে ঘরের চারপাশের বেড়া দেয়া হয়। নূর নাহার নামের এক শিক্ষিকাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্ঠি চাল তুলে তার বেতন পরিশোধ করা হয়।
  
সালেহা বলেন, ‘স্যাপ বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ওই স্কুলে বয়স্ক শিক্ষা শুরু করে। তখন আমি সংস্থার লোকদের বলি আমাদের বয়স নেই। পড়ালেখা করে কি করবো। চাকুরি-বাকরি করতে পারবো না। তার চাইতে আমাগো পোলাপানের লেহাপড়ার জন্য এই স্কুলে একটি টিনশেড ঘর করে দেন। এরপর তারা আমার কথা শুনে প্রথম ৩ হাজার এবং পরে ১০ হাজার টাকা দেয়। হেই টাকা দিয়া চৌচালা টিনশেড ঘর করি। আরো একজন মাস্টার হজলে আলী খাকে রাহি। হেরে গ্রামেগোনে মুষ্টি চাউল উডাইয়া বেতন দেই।’


 
একপর্যায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন টিনশেড ঘরে সংকুলান হচ্ছিল না। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারহ্ কবির গ্রামে আসেন। সালেহার নেতৃত্বে একদল মহিলা সেখানে ছুটে যান। স্কুলের জন্য একটি টিনশেড ঘর দাবি করেন। সে অনুযায়ী একতলা একটি টিনের ঘর তুলে দেন। এভাবেই ২০১২ সালে বিদ্যালয়টি রেজিস্ট্রারভুক্ত হয়। ২০১৩ সালে জাতীয়করন করা হয়। ২০১৫ সালে ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান এইড ও মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় অ্যাকশন এইড ওই ভবন নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করে। 

যেখানে নিজে পড়তে পারেননি সেখানে স্বপ্নজয়ী এ সংগ্রামী নারী সালেহা বেগম শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। সালেহা বেগম আমাদের প্রেরণার উৎস।

ইত্তেফাক/এসসিএস