বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঘটকের অভিনব ‘বিবাহ’ প্রতারণা

আপডেট : ২৪ জুন ২০২১, ২৩:৫৪

চট্টগ্রামে প্রবাস ফেরত, ডিভোর্সি ও স্ত্রী মারা যাওয়া পাত্রদের টার্গেট করে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সুন্দরী মেয়ে দেখানোর পর ঘটক তার নিজ স্ত্রীকে দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাত্রের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও নানান প্রকার প্রসাধনী সামগ্রী।

ঘটকের এমন অভিনব প্রতারণার ফাঁদে নিঃস্ব এক যুবকের অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) ভোরে রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীমের নেতৃত্বে রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি গ্রামে অভিযান পরিচালনা করে আটক করা হয় কথিত ঘটক দম্পতিকে। অভিযানে মোবাইল ডিভাইসসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল প্রতারণার তথ্য প্রমাণও সংগ্রহ করা হয়। 

আটককৃত ঘটক দম্পতি হলেন রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের গশ্চি গ্রামের মৃত মাওলানা মো. হারুনের ছেলে ওকার উদ্দিন আরিফ (৩৮) ও তার স্ত্রী সেলিনা আকতার শিরিন শেলি (৩০)। তাদের বৃহস্পতিবার বিকাল ৩ টায় আদালতে মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মো. আজিজ নামক প্রবাস ফেরত ডিভোর্সি যুবককে অভিযুক্ত ঘটক ওকার উদ্দিন একাধিক পাত্রী দেখানোর পর একটা পাত্রী তার পছন্দ হয়। পছন্দের পাত্রীর নম্বর চাইলে কৌশলে ওই যুবককে ঘটক তার স্ত্রী শিরিনের নম্বর দিয়ে দেন। ঘটকের স্ত্রী ভুক্তভোগী আজিজের পছন্দের পাত্রী সেজে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কয়েক ধাপে বিকাশের মাধ্যমে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩০টাকা হাতিয়ে নেয়। মুঠোফোনে কথা বললেও বিভিন্ন অজুহাতে সরাসরি দেখা করেন ঘটকের প্রতারক স্ত্রী। প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা (মামলা নং-১১, ১৬-০৬-২০২১ইং) দায়ের করেন আজিজ। এই মামলার ভিত্তিতে অভিযুক্ত চক্রের মূল হোতা স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন পুলিশ।

গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই নিজেদের প্রতারণার কথা স্বীকার করে নেয়। এসময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা তাদের প্রতারণার অভিনব কৌশলের কথাও প্রকাশ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে স্বামী ওকার উদ্দিন তার এক সহযোগীকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ডিভোর্স বা স্ত্রী মারা গেছে এমন বিত্তশালী মানুষ, বিশেষ করে বিদেশ ফেরত ও ধনাঢ্য মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের টার্গেট করতেন। তারপর কৌশলে তাদের সাথে পরিচিত হয়ে ঘনিষ্ঠতার এক পর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তিদেরকে জানাতেন যে, তাদের হাতে সুন্দরী ও বড়লোক বাবার মেয়ে পাত্রীর সন্ধান রয়েছে এবং চাইলে তারা পাত্রী দেখানো এবং বিয়ের উদ্যোগ নিতে পারেন। টার্গেট রাজি হলে প্রতারকেরা তাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গিয়ে বেশকিছু পাত্রী দেখাতেন এবং কৌশলে জেনে নিতেন কোন পাত্রীকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই টার্গেটের মোবাইলে সেই পছন্দকৃত পাত্রীর পরিচয় দিয়ে কল করতেন প্রতারক চক্রের সদস্য সেলিনা (ওকার উদ্দিনের স্ত্রী)। দুয়েকদিন অন্তরঙ্গ কথা চালিয়ে যাওয়ার পর বলতেন, তিনি তার মায়ের মোবাইল থেকে কথা বলেন, তাই সবসময় কথা বলা সম্ভব হয় না এবং জরুরি ভিত্তিতে তার একটি মোবাইল ফোন কেনা প্রয়োজন। কয়েকদিন পর বলতেন যে, তিনি অসুস্থ, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, বিভিন্ন ব্যয়বহুল টেস্ট করতে হবে, টাকা দরকার।

এভাবে বিভিন্ন অজুহাতে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ রেকর্ডও করে রাখা হতো। অনেকবার এভাবে টাকা দেওয়ার পর ভিকটিমরা যখন বুঝতে পারতো যে সে প্রতারিত হয়েছে, তখন তাদেরকে হুমকি দেওয়া হত যে, যদি তারা এই বিষয়ে পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে কিছু বলে, তাহলে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে রেকর্ডকৃত অন্তরঙ্গ কথোপকথন পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তারা মোবাইল কলের বদলে অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যাবতীয় যোগাযোগ ও আলাপচারিতা সম্পন্ন করতেন।

পুলিশ সূত্রে আরো জানা যায়, প্রতারক চক্রের মূল হোতা ওকার উদ্দিন নিজেও ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দিন দুবাই প্রবাসী ছিলেন। কিন্তু তাতেও ভাগ্য ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রামের বোয়ালখালির মেয়ে সেলিনা আক্তারকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী এবং অন্য কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন অভিনব এই প্রতারণার ফাঁদ।

এ প্রসঙ্গে অভিযানের নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এই চক্রটির গতিবিধি মনিটর করে আসছিলাম। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি মামলা হওয়ার পর গতকাল রাতে অভিযান চালিয়ে আমরা অভিযুক্ত স্বামীস্ত্রীকে গ্রেপ্তার করি। এই চক্রে জড়িত অন্যান্যদেরকেও অতি শীঘ্রই আইনের আওতায় আনা হবে।

ইত্তেফাক/এসআই