শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

তিস্তা নদীতে নৌকা নয়, চলে গরুর গাড়ি

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৮

‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি কালের বির্বতনে অচল হতে চলেছে। বৈশাখ আসার অনেক আগেই পানি নেই নদীতে।  

কোথাও হাটু পানি, কোথাওবা কম। তিস্তা এখন হেঁটেই পাড় হওযা যায়। তিস্তা নদী দিয়ে এখন গাড়ি চলে। তিস্তার করুন হাল। শুকনো মৌসুমে তিস্তা শুকিয়ে মরুভুমি হয়ে যাচ্ছে। তিস্তার ন্যায্য পানির দাবিতে চলছে সভা-সমাবেশ বিক্ষোভ। সরকারও আশায় বুক বেধে আছে। আশা আর পূরণ হয় না।

হাজার বছর ধরে যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মানববসতি ও সভ্যতা, ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গান, সেই চিরযৌবনা প্রমত্তা তিস্তা ক্রমাগত প্রবীণ হয়ে মরে যাচ্ছে। তার বুক জুড়ে খরস্রোতা জলের স্রোত আর নেই। হিমালয়ের তুষার গলা পানি আর বৃষ্টি ধারায় তিস্তার জল যতই বেড়ে উঠুক, এখন তা মানুষের হাতে বন্দি। তিস্তার বুক জুড়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। উজানে ভারত ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার প্রাকৃতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়। এই নদীর ওপর নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া ও দোয়ানীতে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে কৃষি জমিতে যে সেচ দেওয়ার কথা তাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবেশগত ও নৌ-যোগাযোগ ক্ষেত্রে। দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। প্রকৃতি ক্রমাগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এই তিস্তা নদীর পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পানির স্তর নিম্নমুখী হচ্ছে। 

নদী গবেষক ও রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, উত্তর ভারত উজানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলার গজল ডোবায় ব্যারেজ তৈরি করে সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এই সংযোগ খাল থেকে তারা জলপাইগুড়ি জেলা, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর মালদহ ও কোচবিহার জেলায় সেচ সুবিধা নিচ্ছে। এ অবস্থায় ১৯৭৭ সালে তিস্তা নদীর উপর ব্যারেজ, হেড রেগুলেটর ও ক্লোজার ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। এ বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে গেলে জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা নামক স্থানে (বাংলাদেশ থেকে ৬৩ কিলোমিটার (উজানে) ৯২১ দশমিক ৫৩ মিটার দীর্ঘ ব্যারেজ নির্মাণ করে। এই ব্যারেজটির মাধ্যমে ভারত তিস্তার মোট পানি প্রবাহের ৮০ শতাংশ পানি তিস্তা-মহানন্দা ক্যানেলের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলা, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর মালদহ ও কুচবিহার জেলার ব্যাপক কৃষি জমিতে সেচ প্রদান করছে। উদ্বৃত্ত ২০ শতাংশ পানি ভারত ভাটিতে ছাড়লেও ৬৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই স্রোতধারা বাংলাদেশের দোয়ানীতে ব্যারেজ এলাকায় একেবারেই প্রবীণ হয়ে যায়। ফলে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি কমেছে। ছোট বড় শতাধিক খেয়াঘাট বন্ধ হয়েছে। নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় শ্যালো মেশিন দিয়ে অল্প পানি বের হচ্ছে। এ কারণে সেচ কাজে বিঘ্ন ঘটছে। গঙ্গাচড়ার মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা সাজু মিয়া, রফিকুল, ধামুর গ্রামের হেমন্ত, রবিন, ধরনী এরা সবাই মৎসজীবী। নিজেদের ভিটেমাটি নেই। 

তাদের ভাষায়, ‘গত ডিসেম্বর মাস থেকে তারা বলতে গেলে বেকার। নদীতে পানি না থাকায় মাছ মিলছে না।’ তাই তারা এখন পেশা বদল করে জীবিকা চালাচ্ছেন। কাজের সন্ধানে ছুটছে দক্ষিণাঞ্চলে ও ঢাকা শহরে। আর যারা কৃষক পরিবার তারা বেজায় খুশি কারণ জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করে তারা ফসল ফলাচ্ছেন। 

এখন নদীতে পানি না থাকায় কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্ষা মৌসুমে যখন ফসলের জমিতে পানি থাকবে না, তখন সেচ ব্যবস্থায় ফসল উৎপাদন করার প্রকল্পের কাজ চলছে। নীলফামারী জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আমিনুর ইসলাম (হাইড্রোলজি) তার বক্তব্যে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছেন। শুকনো মৌসুম নয়, বর্ষা মৌসুমে অনাবৃষ্টি হলে তখন ব্যারেজের মূল খালে তিস্তার পানি ঢোকানোর জন্য মূলত ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, এতে ৪.৮৭ মেট্রিক টন ধান অতিরিক্ত উৎপাদন হবে। 

আরও পড়ুন : ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ১৬ অঙ্গরাজ্যের মামলা

তিনি আরও জানান, ভারত যে সময়টাতে তাদের ব্যারেজের গেট বন্ধ করে দেয় তখন পানি সরবরাহ সর্বনিম্ন ১ হাজার কিউসেক পানি সেচ খালে নিলে আর ভাটিতে পানি ছেড়ে দেওয়ার উপায় থাকে না। তবে তিস্তা ব্যারেজের সামনে যে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল জেগে উঠেছে তাতে এ প্রকল্প কৃষি সেচ ব্যবস্থায় কতটুকু সুফল বয়ে আনবে আগামীতে তা নিয়ে নদী বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

ইত্তেফাক/কেকে