শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বড়লেখায় নারী আইনজীবী খুন, ভাড়াটিয়া মাওলানা আটক

আপডেট : ২৭ মে ২০১৯, ১৮:১৫

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় বাবার বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন আইনজীবী আবিদা সুলতানা (৩৫)। রবিবার দিবাগত রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউপির মাধবগুল গ্রামের বাবার বাড়ি থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করেছে।

রবিবার বেলা বারোটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার যে কোনো এক সময় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবিদা মাধবগুল গ্রামের মৃত আব্দুল কাইয়ুমের মেয়ে। তবে কি কারণে আবিদাকে হত্যা করা হয়েছে তা এখনো রহস্যাবৃত। 

পুলিশ এই ঘটনায় ভাড়াটিয়া মাওলানা তানভীর আলমকে (৩০) সোমবার দুপুরে জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে আটক করেছে। ঘটনার পরপরই তানভীর আলম পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আরো দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়েছে পুলিশ। আটক তানভীর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার পিল্লাকান্দি গ্রামের ময়নুল ইসলামের ছেলে। স্থানীয় মসজিদে ইমামতির সুবাদে সে পরিবার নিয়ে আবিদার বাবার বাড়িতে বসবাস করে আসছিলো। 

আটক ভাড়াটিয়া মাওলানা তানভীর আলম। ছবি: ইত্তেফাক

এদিকে নারী আইনজীবী আবিদা সুলতানা খুনের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল এবং কর্মবিরতি পালন করেছেন মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা। 

ঘটনার রাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর মৌলভীবাজারের কর্মকর্তারা ও থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ সময় তারা লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। পাশাপাশি পিবিআই কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। 

সোমবার সকালে নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।   

থানা পুলিশ, স্থানীয় ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউপির মাধবগুল গ্রামের মৃত আব্দুল কাইয়ুমের তিন মেয়ে। স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি দ্বিতীয় মেয়ের স্বামীর বাড়ি বিয়ানীবাজারে থাকেন। আব্দুল কাইয়ুমের তিন মেয়েই বিবাহিত। তাদের মধ্যে নিহত আবিদা সুলতানা সবার বড়। 

আবিদা মৌলভীবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী। স্বামী শরীফুল ইসলাম একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে মৌলভীবাজার শহরে বসবাস করতেন। কোনো ভাই না থাকায় বাবার সব সম্পত্তি নিজেই দেখাশোনা করতেন। বাড়িতে নিজেদের থাকার জন্য দুটি কক্ষ রেখে অন্যগুলো মাওলানা তানভীরকে ভাড়ায় দেন।

গত ২৬মে রবিবার সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টায় আবিদা বিয়ানীবাজারে বোনের বাড়িতে থেকে জরুরী প্রয়োজনে বাবার বাড়িতে যান। এদিনই বাবার বাড়ি থেকে চাল নিয়ে মৌলভীবাজারে স্বামীর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। বিকেল আনুমানিক চারটার দিকে আবিদার বোন তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাচ্ছিলেন না। 

পরে আবিদার বোনেরা তাকে খুঁজতে বাবার বাড়ি দক্ষিণভাগ উত্তর ইউপির মাধবগুল গ্রামে আসেন। বাড়িতে এসে তারা কাউকে পাননি। এ সময় ঘরের একটি কক্ষ বন্ধ দেখতে পেয়ে তাদের সন্দেহ হয়। পরে রাতে তারা পুলিশ নিয়ে গিয়ে ঘরের মেঝেতে বোনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে।

লাশের মাথা থেতলানো। মুখ ও গলা কাপড় দিয়ে পেঁচানো ছিল। পরিধেয় কাপড়ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছিল। পরে পুলিশ লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।

আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: ইত্তেফাক

অন্যদিকে ঘটনার পরপরই ভাড়াটিয়া মাওলানা তানভীর আলম পালিয়ে যায়। পুলিশ ওই রাতে তানভীরের শ্বশুরবাড়ি কাঠালতলী এলাকার টাকী থেকে স্ত্রী ও মাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক তানভীরকে আটক করতে বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান চালানো হয়। পুলিশ খবর পায় তানভীর শ্রীমঙ্গল উপজেলার বরুনা মাদ্রাসা এলাকায় আত্মগোপন করেছে। আত্মগোপনের এই খবরে রাতেই মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান নেয় স্থানীয় থানা পুলিশ।

সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে শ্রীমঙ্গল থানার পুলিশ পরিচয় গোপন রেখে হুজুর সেজে উপজেলার বরুনা মাদ্রাসা এলাকার একটি গ্রাম থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগীতায় তানভীরকে আটক করে। পরে শ্রীমঙ্গল থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর বড়লেখা থানার পুলিশের কাছে তানভীরকে হস্তান্তর করা হয়।

নিহত আবিদার বোনের স্বামী মারুফ আহমদ বলেন, ‘দুদিন আগে তিনি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। রবিবার সকালে আবিদা আপা মৌলভীবাজারে যাওয়ার জন্য আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছিল না। ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। পরে আমার স্ত্রী খুঁজতে এখানে (মাধবগুলে) আসেন। বাড়িতে একটি কক্ষ বন্ধ দেখতে পান। পরে পুলিশ নিয়ে গিয়ে কক্ষ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।’

বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াছিনুল হক বিকেলে বলেন, ‘নিহতের মাথায় ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। সব দিক দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে। তানভীর পালিয়ে গিয়েছিল। শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে আটক করা হয়। তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার রহস্য বের হয়ে আসবে। এই ঘটনায় তানভীরের মা ও স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি।’

আরও পড়ুন: খালিয়াজুরীতে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ ভোগ্যপণ্য

এদিকে নারী আইনজীবী আবিদা সুলতানা খুনের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল এবং কর্মবিরতি পালন করেছেন মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা। বিক্ষোভ মিছিল পরবর্তী সভায় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এসএম আজাদুর রহমান আজাদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরীর সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন বারের সাবেক সভাপতি শান্তি পদ ঘোষ, রমাকান্ত দাস গুপ্ত প্রমুখ। এছাড়া সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।

ইত্তেফাক/নূহু