কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুরে বন্যার্তরা এখনো বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। বন্যাকবলিত এসব এলাকায় দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকলেও ত্রাণের অপ্রতুলতা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, গো-খাদ্য সংকটে বন্যার্তরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। বেড়েছে পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বন্যা শুরুর ১০ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নতুন করে কুড়িগ্রামে ধরলার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় এসব এলাকার মানুষের মধ্যে ফের বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপত্সীমা অতিক্রম করেনি। ইত্তেফাকের আঞ্চলিক অফিস, জেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা সংবাদদাতাদের পাঠানো খবরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ফের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা : পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতি ৩০ জুলাই থেকে ক্রমাগত উন্নতি হতে পারে। তবে ২৫ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ফের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত দেশের প্রধান নদ-নদীর ২১টি পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরমধ্যে সুরমার কানাইঘাটে ৬৭ সেন্টিমিটার, আত্রাইয়ের বাঘাবাড়ি ৫৫ সেন্টিমিটার বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অপরদিকে, ধলেশ্বরীর এলাশিন পয়েন্টে পানি হ্রাস পেয়ে ৭১ সেন্টিমিটার ও যমুনার বাদুরাবাদে ৩৬ ও ফুলছড়ি পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আজ বুধবার উত্তরাঞ্চলে হতে পারে ভারী বৃষ্টিপাত।
১২ দিনে ৮৭ জনের মৃত্যু : বন্যার কারণে গত ১২ দিনে বিভিন্ন জেলায় মারা গেছে অন্তত ৮৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হিসাবে এ তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে ৭০ জনই মারা গেছে পানিতে ডুবে। আর মৃতদের ২৯ জনই জামালপুরের বাসিন্দা। এ ছাড়া, গাইবান্ধায় ১৫ জন, নেত্রকোনায় ১৩ জন এবং টাঙ্গাইল ও সুনামগঞ্জ জেলায় ৫ জন করে রয়েছে। ইত্তেফাকের শেরপুর প্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী গত সাত দিনে এ জেলায় মারা গেছে ১১ জন। গতকাল সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মৃত মরিয়ম খাতুন (৮) উপজেলার চরকুকরী পশ্চিম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ও কুকরী কলেজপাড়া মহল্লার বাবু সিকদারের মেয়ে।
এদিকে, জামালপুর জেলায় ৬২টি ইউনিয়ন ও সাতটি পৌরসভায় বন্যাকবলিত প্রায় ২২ লাখ মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। শুকনো খাবার, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি ও গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামে। বন্যাকবলিত এ সব জেলার লাখ লাখ মানুষ এখনো বাঁধে, সড়কে, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে ও নৌকায় এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রিত। অনেক স্থানে পানি নেমে গেলেও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও কদর্মাক্ত হওয়ার কারণেও মানুষ ঘরে ফিরতে পারছে না। সরেজমিনে দেখা যায়, গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ গাইবান্ধা সড়কে শহরের নতুন ঘাঘট ব্রিজ থেকে পূর্ব দিকে চার কিলোমিটার সড়কের দুই ধারে সারি সারি পলিথিনের ছাউনি। বৃষ্টিতে ভিজছে ও রোদে পুড়ছে সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া এ রকম কয়েক লাখ বানভাসি মানুষ। এদিকে বাঙালি ও করতোয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পৌরসভাসহ কয়েকটি গ্রামে নতুন করে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়াও ঘাঘট নদীর শহররক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপত্সীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর ও ঘাঘট নদীর পানি বিপত্সীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধা জেলা শহরের সঙ্গে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে কাভার্ডভ্যানের পেছনে মোটরসাইকেলের ধাক্কা, নিহত ২
এ দিকে, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বানের পানি কিছুটা কমতে না কমতেই আবারও বাড়তে শুরু করেছে। চরম অবনতি ঘটেছে বন্যা পরিস্থিতির। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বানভাসি মানুষ। উলিপুরে তিস্তার বাম তীর রক্ষায় টি-বাঁধটির ফের ৫০ মিটার ধসে গেছে। এতে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান বাঁধের পাড় এলাকায় নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ২০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। বন্যায় মৌলভীবাজারের সদর ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার দুই উপজেলার গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১৫৮টি গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইত্তেফাক/অনি