শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঝিয়ের কাজ করে বেঁচে আছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৯, ১৭:২৯

'মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দুই বছর আগে আজাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। দেড় বছর পরে গর্ভে জন্ম নেয় একটি কন্যা সন্তান। আমাকে ঘরে একা রেখে প্রায় সে গভীর রাতে বাইরে যেতো। জিজ্ঞাসা করলে আমাকে বলে দেশে যুদ্ধ শুরু হবে। আমি পুটিমারীর হিন্দুদের বড়াই বাড়ি দিয়ে ভারতে পার করে দিবো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ৪ মাসের শিশু আরজিনাকে কোলে নেয়। আদর করে মেয়ের দুই গালে ও মুখে চুমু খায়। মেয়েকে আমার কোলে দিয়ে বলে ওর প্রতি খেয়াল রেখো। তার চলে যাওয়ার সময় বাবা মায়ের সামনে লজ্জা-শরমে শুধু দাড়িয়ে ছিলাম। আমার বয়স তখন ১৮/২০। তাকে আমার অনেক কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও বলা হয়নি।'

সংসার জীবনে স্বামীর সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত এবং স্বামীকে শেষ দেখার স্মৃতি এভাবেই বয়ে চলেছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর স্ত্রী বুলবুলি বেগম।

তিনি বলেন 'যুদ্ধ চলাকালীন ওর জন্য রাস্তার পানে চেয়ে থাকতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫ দিন পর শরিফুল প্রিন্সিপাল জানায়, আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। সরকার আমাকে অনেক কিছু দেবে। কিন্তু হায়! কেউ আমার দুঃখ কষ্টের কোনদিন খবর নেয়নি। তখন থেকে আমি পিঠার দোকান ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাই।'

স্বামীর সঙ্গে কাটানো সুখের স্মৃতি আর বর্তমান দুর্দশা মিলেমিশে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এসব কথা বলেন কিশোরগঞ্জের চাঁদখানা ইউনিয়নের আলুপাড়া গ্রামে বাস করা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর স্ত্রী বুলবুলি বেগম।

গ্রামবাসী জানায়, বুলবুলি বেগমের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ মিস্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সম্মুখ সমরে অক্টোবর মাসে শহীদ হন। দেশ স্বাধীনের পর থেকে অর্থাভাবে তার স্ত্রী বুলবুলি বেগম অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এখন পর্যন্ত তিনি কোনো সরকারী সুবিধা পাননি।

সমাজ সেবা অফিসের মাধ্যমে ২০১৫ সালে আবেদন করেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তার ভাগ্যে মেলেনি সম্মানি ভাতার কার্ড। ২০০৫ সালের গেজেটে শহীদ ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আজাদ মিস্ত্রী। কিন্তু জেলা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম শহীদ আজাদ আলী। নামের শেষে গেজেটে মিস্ত্রী এবং জেলা তালিকায় আলী লিপিবদ্ধ হওয়ায় অজুহাতে সম্মানী ভাতার জন্য তার স্ত্রী, কন্যা ও জামাতা দীর্ঘদিন ধরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সাবেক আনসার এ্যাডজুটেন্ট ও পুটিমারী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা কেফায়েত হোসেন বলেন, শহীদ আজাদ মিস্ত্রী ৬ নং সেক্টেরে যুদ্ধ করেছেন। আমি ওই সেক্টেরের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। তিনি হাতিবান্ধায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। সেখানে তার কবর রয়েছে। আমার প্রস্তাবনায় উপজেলা হতে পুটিমারী সড়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজাদ আলী নামকরণ করা হয়েছে। অথচ তার অসহায়, দুঃস্থ স্ত্রী অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে সম্মানী ভাতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে হন্য হয়ে ঘুরছেন। সামান্য অজুহাতে তাকে ভাতা বঞ্চিত করা হয়েছে। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর এ দুরাবস্থা কী মেনে নেয়া যায়!'

এ ব্যাপারে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সাদিকুর রহমান জানান, 'বিষয়টি আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। আবেদন পাইনি। দুই মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। আমার কাছে আবেদন উপস্থাপন করেনি। বিষয়টি দেখা লাগবে।'

আরও পড়ৃন: পূর্ব সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে মৃত বাঘ!

আবেদনকালীন সময়ের উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবুল বলেন, 'শহীদ ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম কাগজপত্রে ভিন্নতা থাকায় সংশোধন করতে বলা হয়েছিলো। এতদিনে করতে পারে নাই। বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বলেছি। প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত হয়ে যাবে।'

ইত্তেফাক/নূহু