শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অস্ত্র-বিস্ফোরক ঢোকার শঙ্কা

আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২৭

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে অবৈধভাবে অস্ত্র-বিস্ফোরক প্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে গত বছর বন্দরে বহুল আলোচিত ২২টি পণ্য চালান খালাস হওয়ার ঘটনায় এ শঙ্কার কথা ব্যক্ত করে একটি গোপন প্রতিবেদনে বন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো এই নির্দেশনার সঙ্গে গোপনীয় প্রতিবেদনটিও সংযুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, অবৈধভাবে পণ্য খালাস করাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হচ্ছে। আশঙ্কা রয়েছে, এ ধরণের ঘটনার মাধ্যমে পণ্য আমদানির আড়ালে অবৈধ পণ্য বিশেষত মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ দেশে প্রবেশ করতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আমদানি জালিয়াতিতে জড়িত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ও বন্দরের দায়িত্বে থাকা ৩২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট আমদানি চালানের সঙ্গে জড়িত ২২ আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অবসরে যাওয়া দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি হ্যাক করে গত বছর ২২টি পণ্যচালান অবৈধ উপায়ে খালাস করা হয়। অথচ ঐ পণ্যচালানে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির তথ্য থাকায় তা খালাস না করতে তত্কালীন শুল্ক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছিলো শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। পণ্য খালাসের ঘটনা তদন্তে তখন ‘কোঁচো খুড়তে অজগর’ বেরিয়ে আসে। জানা যায়, অবসরে যাওয়া ঐ দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে প্রায় চার হাজার বার অনলাইন সার্ভারে প্রবেশ করা হয়েছে। ফলে এই উপায়ে কী পরিমাণ পণ্য খালাস হয়েছে তা নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হয়। রাজস্ব ক্ষতির পাশপাশি এসব চালানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর কোন বস্তু খালাস হয়েছে কিনা - তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়। এ ঘটনার পর এনবিআরের উদ্যোগে আলাদা চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে একাধিক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে কিছু খোলাসা করছে না এনবিআর।

তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন: এদিকে এনবিআর গঠিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সঠিক তদন্ত হওয়া নিয়ে ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদেনে। এতে বলা হয়, জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য পাচারের ঘটনায় জড়িত শুল্ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এবং তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তারা একজন আরেকজনের পরিচিত। ফলে এই তদন্ত কমিটি দিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত পরিচালিত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এছাড়া ওই জালিয়াত কর্মকান্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাগণ কাস্টম হাউজে এখনো কর্মরত। ফলে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতিবাজ শুল্ক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বড় জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও সার্ভার হ্যাক করার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এতে অসাধু আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত।

সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তদের অন্যত্র বদলি, ২২টি চালান খালাসের ঘটনায় সম্পৃক্ত সিএন্ডএফ এজেন্টদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা, এনবিআরের কাস্টমসের স্বয়ংক্রিয় ডাটা সার্ভারের (এসাইকুডা) সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীরা অবসরে গেলে কিংবা বদলি হলে তাদের ইউজার আইডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ও চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমসের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্পদের তদন্ত করা এবং কাস্টমস ও বন্দর কর্মকর্তাদের সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ভেটিং বা যাচাই করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জালিয়াতিতে জড়িত যে ৩২ কর্মকর্তা-কর্মচারী: তদন্তে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের তত্কালীন দায়িত্ব পালনকারী ১৫ জন ও বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা ১৭ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনে তাদের ‘চরম দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্মকর্তারা হলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম সরোয়ার (বর্তমানে এনবিআরে কর্মরত), উপ-কমিশনার (ডিসি) শাহিনুর রহমান পাভেল, রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, শহিদুল ইসলাম, নুরে আলম, হাবিবুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, মেহেরাব আলী, এস এম মোশারফ হোসেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এ এইচ এম নজরুল ইসলাম, শাহরিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ নূর ই আলম, সাইফুন্নাহার জনি ও মির্জা সাইদ হাসান ফরমান।

বন্দর বিভাগের অভিযুুক্তরা হলেন উচ্চমান সহকারী মো. শাহাবুদ্দিন, মো. সানোয়ার মিয়া, মো. মফিজুর রহমান হেলেন, শেখ বাচ্চু মিয়া, মো. ইলিয়াস, মো. হামিদুর রহমান, নাজিম উদ্দীন, কবির আহম্মেদ, শ্যামল কৃষ্ণ ভৌমিক, সালাউদ্দিন পায়েল, মোরশেদুল হাসান, ওমর ফারুক, অর্পন কান্তি দেবনাথ, মাইনুদ্দীন, অনিক, আব্দুল গনি ও মোস্তাফিজুর রহমান।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চালানগুলোতে ঘোষণা বহির্ভূত, উচ্চ শুল্কহারযুক্ত, আমদানি নীতি আদেশ পরিপন্থী, জাতীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ পণ্য থাকায় লক থাকার পরও অভিনব কায়দায় অবৈধ অর্থের বিনিময়ে খালাস করা হয়েছে।

দায়ী ১৪ আমদানিকারক ও ৮ সিএন্ডএফ এজেন্ট :খালাস হওয়া ২২টি চালান ১৪ আমদানিকারকের নামে এসেছিলো। এসব চালানের বেশিরভাগই এক্সেসরিজ, ক্যাপিটাল মেশিনারিজসহ স্বল্প শুল্কের পণ্য হিসেবে আমদানি করা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে সেগুলোতে কী ছিল তা এখনও জানা যায়নি। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ঢাকার এস ও এস ইন্টারন্যাশনাল, গাজীপুরের দাদ এন্টারপ্রাইজ, নবাবপুর রোডের এম এস সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, গুলশানের জারার এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার আরকে ইন্টারন্যাশনাল, গুলশানের রিফাত ট্রেডিং, মুভিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, উত্তরার এইচ এল ট্রেডিং, হাতিরপুলের মিমি লেদার কটেজ, মতিঝিলের এ কিউ ট্রেডিং, পুরনো ঢাকার মৌলভীবাজারের এম এস জাহিত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এম ডি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল, চকবাজারের এস পি ইন্টারন্যাশনাল ও পাবনার এস কে এস এন্টারপ্রাইজ।

অভিযুক্ত ৮টি সিএন্ডএফ এজেন্ট হলো চট্টগ্রামের লাবনী এন্টারপ্রাইজ, চাকলাদার সার্ভিস, এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এম এন্ড কে ট্রেডিং, মজুমদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, লায়লা ট্রেডিং, স্মরনিকা শিপিং কাইজেন ও মুজিব ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

ইত্তেফাক/এমআই