শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্কুল মাস্টারের ছেলে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন সোনারগাঁয়ের জি কে শামীম

আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:০১

একজন স্কুল মাস্টারের ছেলে হয়ে ওঠেন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন। অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা ও রাজনীতির অন্তরালে চাঁদাবাজী, জুয়া ও ক্যাসিনো চালিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জি কে শামীম।

ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে আটক হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদের পরই নাম উঠে আসে এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের। অস্ত্রধারী দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে সব সময় চলাফেরা করা এই শামীমকেও শুক্রবার ৭ দেহরক্ষীসহ আটক করা হয়।

জি কে শামীমের গ্রেফতারের পর তাকে যুবলীগের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের কোন সভা-সমাবেশে তাকে দেখা না গেলেও নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে কেন্দ্রীয় যুবলীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়ার পর এনিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা।

জি কে শামীম জেলা আওয়ামী লীগের কোন পদবীতে আছে এমন কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও জি কে শামীমকে অর্থের বিনিময়ে একটি পক্ষ তাকে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করতে চেয়েছিলো এমন গুজব শহরময় ভেসে বেড়াচ্ছে। 

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই জানান, ডা: সেলিনা হায়াত আইভী নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। তাছাড়া জি কে শামীম জেলা আওয়ামী লীগের কোন পদেই নেই। এ নিয়ে ধ্রুমজাল সৃষ্টি হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আরজু রহমান ভূইয়া জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহিদ বাদল জি কে শামীমকে সহ-সভাপতি করার প্রস্তাব দিলে মেয়র আইভীসহ অন্যদের বিরোধীতায় তা বাতিল হয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা আশঙ্কা করছেন, কার্যকরী পরিষদকে না জানিয়ে গোপনে জি কে শামীমের নাম সহ-সভাপতি হিসেবে কেন্দ্রে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। যদিও এ ধরণের বক্তব্যকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন।

শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীমের কার্যালয় থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ অভিযান ১ কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব। ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) ও ডলার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিছু মাদকও উদ্ধার করা হয়।

অভিযান শেষে শামীমের নিকেতনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, অভিযান ১ কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) পেয়েছি। এর মধ্যে তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকা ও ২৫ কোটি টাকা তার নামে। এ ছাড়া তার কাছ থেকে মার্কিন ডলার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। এগুলোর লাইসেন্সের সত্যতা আমরা যাচাই করব। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আটজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছি।

সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন কে এই জি কে শামীম। ছোটখাটো মানুষ হলেও শামীমের ক্ষমতার দাপট ছিল আকাশসমান। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজই জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে এ শামীম ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি। এক সময়ের যুবদল নেতা ক্ষমতার পরিবর্তনে হয়ে যান যুবলীগ নেতা। 

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেজো। বড় ছেলে গোলাম হাবিব নাসিম ঢাকায় জাতীয় পার্টি রাজনীতি করেন।

সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুল পাস করার পর তাদের আর গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম।নিম্ম মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে এসে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি। বনানীর ডিওএইচএসে বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন শামীম। আর গুলশান নিকেতনে ৫ নম্বর সড়কের ১৪৪ নম্বর ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি।

সাধারণ জনগণের কাছে অতেটা পরিচিতি না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিচিতি পান শামীম। সেই নির্বাচনে শামীম আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু বলছেন ভিন্ন কথা। যুবলীগের নন, জি কে শামীম যুবদলের সাবেক সহ-সম্পাদক বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, যুবলীগে শামীমের কোনো পদ নেই। তিনি নিজেই নিজেকে সমবায় বিষয়ক সম্পাদক বলে বেড়ান। এ নিয়ে যুবলীগে কয়েকবার আলোচনাও হয়েছে। তাকে কয়েকবার এমন মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে বলাও হয়েছে।বাবলু আরও দাবি করেন, জিকে শামীম এক সময় যুবদলের সাবেক সহসম্পাদক ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি বলে শুনেছি।

বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা গণমাধ্যমকে জানান, বর্তমানে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই রাজনীতি শুরু করেন শামীম। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। এ সময় ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদকের পদ হাতিয়ে নেন। সে সময় বিএনপির বড় বড় নেতাদের ছবিসহ সবুজবাগ-বাসাবো এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীমের ব্যানার-পোস্টার শোভা পেত বলে জানান এজিবি কলোনির বাসিন্দারা।

বিএনপির নেতাতাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবন তার দখলে ছিল। এ সময় শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ঠিকাদার হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে শামীম যুবলীগে ভিড়েন। টাকা ও প্রভাব খাটিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। বর্তমান তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা।এখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবিসহ শামীমের পোস্টার-ব্যানার ঝুলছে। 

ক্ষমতায় পরিবর্তন এলেও শামীমের ভাগ্য সুপ্রসন্নই থেকে গেছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে যেভাবে দাপটের সঙ্গে গণপূর্তে ঠিকাদারি ব্যবসায় একক আধিপত্য ছিল তার, আওয়ামী সরকারের আমলেও একইভাবে রাজত্ব করে যাচ্ছেন এই যুবলীগ নেতা। ছয়জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী সবসময় ঘিরে থাকত শামীমকে। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর তার বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন অনেকে। 

আরও পড়ুন: কেবল তর্ক করার কারণে শ্যালিকা ও তার দুই মেয়েকে হত্যা করে আব্বাস

এদিকে জি কে শামীম সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, জি কে শামীম আওয়ামী লীগের কেউ নয়। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে তার কোন পদ পদবী নেই।

ইত্তেফাক/নূহু