ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প যে শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন তা ফিলিস্তিনিরা প্রত্যাখান করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে এটিকে শতাব্দীর সেরা চুক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই চুক্তি শুধু ফিলিস্তিনিরা নয়, দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি জাতিসংঘ এই চুক্তির মাধ্যমে সংকট সমাধানের কোনো আশা দেখছে না। কারণ এটি আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি ও চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এই চুক্তিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। ফিলিস্তিন ইস্যু শুধু ভূখণ্ড ভাগাভাগির কোনো ইস্যু নয়। এর সঙ্গে অনেক নীতিগত প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।
ফিলিস্তিন ইস্যু যে একটি নীতিগত ইস্যু তা বোঝার জন্য বাদশাহ ফয়সাল এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গলের সংলাপের একটি উদাহরণ আমরা মনে করতে পারি : ডি গল দাম্ভিক স্বরে বাদশাহ ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘লোকেরা বলে, হে মহান বাদশাহ! আপনি ইসরায়েলকে সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দিতে চান! ইসরায়েল তো বাস্তবে পরিণত হয়েছে এবং কেউ আপনার কথা মেনে নেবে না!’
বাদশাহ ফয়সাল ডি গলকে জবাব দিলেন, ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট! আমি আপনার এ কথায় অবাক হয়েছি। হিটলার যখন প্যারিস দখল করল এবং তার দখল বাস্তবে পরিণত হয়েছিল এবং পুরো ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করেছিল তখন আপনি ফ্রান্স ত্যাগ করে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন...এবং এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সাফল্য অর্জন না করা অবধি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। আপনি প্রচেষ্টা ছেড়ে দেননি এবং আপনার লোকেরাও ছাড়েনি। আর এই প্রচেষ্টার ফলে আপনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনগণকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি এখন অবাক হচ্ছি যে আপনি আমাকে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সন্তুষ্ট থাকতে বলছেন! আর দুর্ভাগ্যজনক, মাননীয় প্রেসিডেন্ট! দুর্বলরা শক্তিশালীদের দ্বারা যদি দখল হয়ে থাকে, এবং জেনারেল ডি গলের স্বর্ণ নীতিমালায় তা বাস্তব রূপ নেয়, তাহলে তো দখলদারীদের দখলটাও বৈধ হয়ে যায়!’
জেনারেল ডি গল বাদশাহ ফয়সালের উপস্থিত বক্তব্যর যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হয়ে নিজের সুর পালটে বললেন, ‘মহান বাদশাহ, ইহুদিরা বলে যে ফিলিস্তিন তাদের প্রকৃত দেশ এবং তাদের পরদাদা ইসরায়েল সেখানকারই সন্তান।’
বাদশাহ ফয়সাল জবাব দিলেন, ‘হে মহান প্রেসিডেন্ট! আমি আপনার প্রশংসা করি, কারণ আপনি নিজের ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী এবং আপনি নিঃসন্দেহে বাইবেল পড়েছেন, আপনি কি পড়েননি যে ইহুদিরা মিশর থেকে এসেছিল? দখলদার হিসেবে জয় লাভ করেছিল, ফিলিস্তিনিদের শহর পুড়িয়েছিল এবং পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের হত্যা করেছিল, তাহলে আপনি কীভাবে বলবেন যে ফিলিস্তিন তাদের দেশ এবং এটি আরব কেনানীয়দের? বরং ইহুদিরা ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। আর আপনি চান সেই উপনিবেশবাদ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে, যা ইসরায়েল চার হাজার বছর আগে করেছিল? ফ্রান্স মাত্র তিন হাজার বছর আগে ছিল রোমান উপনিবেশ। বিশ্বের মানচিত্র কি ইহুদিদের পক্ষে বৈধ এবং রোমের পক্ষে নয়? আমরা আরবরা ফ্রান্সের দক্ষিণে দুই শত বছর কাটিয়েছি, যখন ইহুদিরা কেবল সত্তর বছর ফিলিস্তিনে অবস্থান করেছিল, তারপরে তারা বিতাড়িত হয়েছিল!’
ডি গল বললেন, ‘কিন্তু তারা বলে যে তাদের পিতারা এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন!’
বাদশাহ ফয়সাল বললেন, ‘আজব! আপনার প্যারিসে এখন দেড় শতাধিক দূতাবাস রয়েছে এবং বেশির ভাগ রাষ্ট্রদূতের সন্তান প্যারিসে জন্মগ্রহণ করে। যদি এই শিশুরা তাদের দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যায় এবং তারা প্যারিসে জন্মের সূত্রে এইখানে দখল নেওয়ার অধিকারের দাবি জানায়! আমি জানি না তখন প্যারিস কার জন্য হবে!’
ডি গল কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলেন এবং ঘণ্টায় আঘাত করে পম্পিডুকে ডেকে পাঠালেন, যিনি তখন বাইরে রাজকুমার সুলতান বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ এবং তত্কালীন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রাশাদ মাহমুদ ফেরাউনের সঙ্গে বসেছিলেন। ডি গল এরপর বললেন, ‘ফিলিস্তিনের বিষয়টি এখন বুঝতে পারলাম, ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি করা বন্ধ করো।’ এ সময় ইসরায়েল আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকান নয়, ফরাসি অস্ত্র ব্যাবহার করছিল।
আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে দেখা যাবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি মানেনি। ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি হঠাত্ করে উপস্থাপন করা হয়নি। দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী মহল। ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সেন্টিমেন্টকে এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে কট্রর ইহুদি ধর্মবিশ্বাসের আলোকে দেখা হয়েছে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একজন ফিলিস্তিনি কূটনীতিকের কাছে ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনার ব্যাপারে মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানালেন, ‘পুরো ফিলিস্তিন এখন সংঘবদ্ধ। আমাদের যত রাজনৈতিক দল আছে, ফাতাহ, হামাস, আল-জিহাদ, ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, ফিলিস্তিন ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন, আসসাইকা, প্যালেস্টিনিয়ান পিপলস পার্টি, প্যালেস্টিনিয়ান কমিউনিস্ট পার্টিসহ সাধারণ জনগণ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। এমনকি ফিলিস্তিন সংসদে সবাই এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। এই পরিকল্পনা কোনো সমঝোতার পরিকল্পনা নয়। এতে শুধু ইসরায়েলের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা কার্যকর করার অর্থ ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ন্যায্য ভূমির মাত্র ১৫ শতাংশ ধরিয়ে দেওয়া। আমাদের সব নৌপথ, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, শহর সবকিছু তাদের দখলে নিয়ে আমাদের পরনির্ভর করে রাখা—এই পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি জাতিবিদ্বেষ নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা ন্যায়সংগত, দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাসী। বাস্তবতা হচ্ছে ইসরায়েল নয় “শান্তির জন্য” ফিলিস্তিনিরা অনেক চেষ্টা করেছে এবং ছাড় দিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রূপকার ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের অনুমোদিত শান্তি চুক্তি “অসলো অ্যাকর্ডস”। যেখানে ১৯৬৭ সালের সীমান্তের মধ্যে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের মাত্র ২২ শতাংশ অংশ নিয়ে হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
অসলো চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। এর পরিবর্তে একটি জিনিসই ইয়াসির আরাফাত চেয়েছিলেন, পবিত্র ভূমি জেরুজালেম। এ নিয়ে ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে অন্তহীন বৈঠক করার পরও তারা রাজি হননি। ২০০২ সালে আরব শান্তি উদ্যেগে ৫৭টি আরব ও ইসলামিক দেশ সমর্থন জানিয়েছিল। দুঃখজনক হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শান্তি পরিকল্পনা ফিলিস্তিনকে এই ২২ শতাংশ অংশের নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়নি। বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেমও কেড়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদদের মতে, শতাব্দীর চুক্তিটি মূলত ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার হরণ এবং আরব অঞ্চলের ওপর ‘স্টেট অব ইসরায়েল’ সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা মাত্র। যেখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মাত্রার সঙ্গে ইসরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আবিষ্কারের ফল নয়, বরং পরিকল্পিত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বহু দশক ধরে ইসরায়েলের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
সাহাবি ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেছিলেন, ‘অধিকার পুরোনো হলেও সীমাবদ্ধতার আওতায় পড়ে না।’
অর্থাৎ, সময় যতই পার হয়ে যাক না কেন, ন্যায্য অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না। তেমনি, ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারও চিরকাল বাস্তব থাকবে। ইসরায়েল ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই শতাব্দীর চুক্তির ঘোষণার বিরুদ্ধে ডাকার থেকে জাকার্তা পর্যন্ত বিশ্বের সব মুসলিম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণও এই এই ঐক্যর অংশীদার।
ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের মানুষ ও সরকার সব সময় কাজ করে যাব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্তির দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : ড. মুহাম্মদ এনামুল হক চৌধুরী
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ