শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অজেয় আফগানিস্তানে জয়ী কে!

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:৫০

মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মার্কিন-আফগান যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে লক্ষ্যে কাতারে তালেবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলমান। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। কাতারের বহুজাতিক শান্তি বৈঠকে আফগান সরকারের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি। তালেবানরা বর্তমান সরকারকে বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে মানে না। আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মহিব এই আলোচনায় আফগান সরকারের অংশগ্রহণ প্রয়োজন দাবি করে বলেন, মার্কিন সৈন্য চলে যাওয়ার পরও যুদ্ধ চলবে। এই যুদ্ধ চালাতে হবে আফগান সরকারকে।

কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা এই যুদ্ধে হার মেনে আফগান ভূমি ছাড়তে হচ্ছে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যদের। অথচ ২০০১ সালে যুদ্ধ শুরুর আগে ভেবেছিল রোমান সম্রাট নেপোলিয়ানের মতো ‘আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ নীতিতে তারা জয় করে আফগান ভূমি। ব্যর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয় তারা আফগান ছাড়লেই তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নিবে। কেননা আফগানিস্তানের ৭০% এলাকা এখনো তালেবানদের হামলার হুমকিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান ছাড়লে সেখানে পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও চীন প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। এসব দেশ তালেবানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখছে। অন্য দিকে মার্কিন মিত্র ভারত আফগানিস্তানে তার প্রভাব তৈরির চেষ্টা করলেও তালেবানরা ঘোরতর ভারতবিরোধী।

আফগানিস্তান বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি দেশ। অজেয় আফগানিস্তানে আশির দশকে পরাজয় বরণ করে দেশ ছাড়তে হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা সামরিক শক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়নকে। ১৯ শতকে আফগানরা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকেও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পাথুরে পাহাড়, মরু আর গুহা অঞ্চলে টিকে থাকা চরম কষ্টসহিষ্ণু জাতি আফগানরা। ফলে এই অঞ্চলে পশ্চিমা বাহিনীরা পেরে উঠতে পারে না আফগান যোদ্ধাদের সঙ্গে। ঠিক একই কারণে পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্যদেরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এক বছর ধরে যুদ্ধ করলেও সেখানকার সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের ভাষা সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। ইরাক ও লিবিয়ার মতো আফগান সমাজও মূলত গোষ্ঠীভিত্তিক এবং আধুনিক পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা থেকে মূল্যবোধ ও ক্ষমতার কাঠামোতে সম্পূর্ণ আলাদা। এসব স্থানীয় মূল্যবোধের প্রতি মার্কিন সৈন্যদের অবজ্ঞা সাধারণ আফগানিদের সব সময় ক্ষুব্ধ করেছে। যে গেরিলা বাহিনীর প্রতি স্থানীয়দের সমর্থন রয়েছে তাদের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। তার অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ফলে আফগানিস্তানে তালেবানরাই বার বার জয়ী হচ্ছে। গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে গণতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। আফগান ঐতিহ্যের মধ্যে নির্বাচনের ধারণাটাই নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র ২০% মানুষ ভোট দিতে গিয়েছিল। পরাজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মার্কিন সৈন্যরা জানত না তারা কিসের জন্য লড়ছে। মার্কিন প্রশিক্ষিত আফগান সৈন্যরাও শুধু অর্থের জন্য লড়াইটা করছে। কিন্তু তালেবানরা লড়াই করছে একটা ‘আদর্শ ও উদ্দেশ’কে সামনে নিয়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যেতে তারা বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। কিন্তু আফগান নারীদের আধুনিক করার এই চেষ্টা আরো বুমেরাং হয়েছে। সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া যায় না। পশ্চিমা মূল্যবোধ চাপানোর চেষ্টা আফগান সমাজে বরং অস্থিরতাই তৈরি করেছে। একটি সমাজ বা দেশকে ঠিক তার সংস্কৃতি ও অভ্যস্ততা মতে চলতে দিতে হবে। হঠাত্ করে পশ্চিমা সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা আফগানিস্তানের গুহায় অগ্রহণযোগ্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসব ভুল আফগান নীতি তাদের ভূমিধস পরাজয়ের কারণ। অর্থ অপচয় ও নিজেদের সৈন্য হারানো ছাড়া আফগান যুদ্ধে তাদের কোনো অর্জন নেই। মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান ছাড়ার পর তাদের পুতুল সরকার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টাও সফল হবে না। কারণ বর্তমান সরকারের প্রতি আফগান জনগণের সমর্থন নেই। সুতরাং তাদের সমাজ, অবকাঠামো ও সরকার গঠনের দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধরে রাখা আফগানিরা শুকনো রুটি খেয়ে গুহায় রাত পার করে বিশ্বের বড়ো সাম্রাজ্যবাদীদের নিজ দেশ থেকে হটিয়েছে। বিদেশি পরাশক্তিদের চাপিয়ে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদকে আফগানিস্তান কখনো গ্রহণ করেনি। সুতরাং নতুন আফগান গঠনের দায়িত্ব দিতে হবে আফগানদের। তবেই সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী শান্তি ফিরবে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধরত পশ্চিম এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানে।

 

লেখক: শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়