বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০২০

জয়ের লাটাই বিদেশি শক্তির হাতে!

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৩৪

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। যুদ্ধ, মহামারি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কোনো আন্তর্জাতিক সংকটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী ভূমিকা রাখেন সেদিকেই সবাই লক্ষ্য রাখেন। এ কারণেই প্রতি চার বছর পরপর যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তখন এর ফলাফল কী হবে তা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই তৈরি হয় ব্যাপক আগ্রহ। কিন্তু এবারের নির্বাচন নিয়ে অনেক শঙ্কা জাগছে। নির্বাচনে বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে পারে এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন গোয়েন্দাদের মধ্যেই। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জোরালো অভিযোগ পাওয়া গেলেও এবার আগেভাগেই সেই অভিযোগ আসছে এবং এ নিয়ে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বাগিবতণ্ডাও শুরু হয়েছে। আশঙ্কা জাগছে যে, এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে বিদেশি শক্তি!

বিদেশি হস্তক্ষেপের আশঙ্কা বাড়ছে

গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এবং সিকিউরিটি সেন্টারের পরিচালক উইলিয়াম ইভানিনা আকস্মিক এক ঘোষণায় জানান, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া, চীন এবং ইরান হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছে। এক বিবৃতিতে ইভানিনা বলেন, এরা গোপনে এবং প্রকাশ্যে আমেরিকান ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। চীন চাইছে না ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার জিতে হোয়াইট হাউজে থেকে যান। অন্য দিকে রাশিয়া ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের ক্ষতি করতে চাইছে। মার্কিন গোয়েন্দারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পের সমর্থনে কাজ করেছে। ইভানিনার মতে, বিদেশি কিছু রাষ্ট্র ভোটারদের পছন্দ প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে গিয়ে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের উসকানি দিচ্ছে, দেশের ভেতর মতভেদ তৈরি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের আস্থা নষ্টের চেষ্টা করছে।

তবে মার্কিন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রধান একই সঙ্গে বলেন, ভোটের ফলাফল নির্ধারণে আমাদের শত্রুরা খুব বেশিকিছু করতে পারবে না। ইভানিনা বলেন, মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং টিভিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার কাজ শুরু করেছে। ইরানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাটো করার চেষ্টা করছে। নানা প্রচারণা চালিয়ে আমেরিকান জনমত বিভক্ত করতে তত্পর হয়েছে। তিনি বলেন, ইরান মনে করছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি ইরানে সরকার পরিবর্তনের জন্য চাপ অব্যাহত রাখবেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, রাশিয়া নির্বাচনে মাথা গলানোর চেষ্টা হয়তো করতে পারে, কিন্তু মস্কো তার পক্ষে কাজ করবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সর্বশেষ যে মানুষটিকে রাশিয়া জয়ী দেখতে চায় তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমি রাশিয়ার ব্যাপারে যতটা শক্ত, আগে কোনো প্রেসিডেন্ট এতটা ছিলেন না। চীন সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, তিনি হারলে চীন যে খুশি হবে তা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি মন্তব্য করেন, জো বাইডেন জিতলে চীন আমেরিকায় কর্তৃত্ব করবে। ডেমোক্র্যাটরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর চাপ তৈরি করেছে যে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে তারা মানুষকে অন্ধকারে রাখছে। ইভানিনা অবশ্য তার বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচন সম্পর্কিত কোনো ধরনের হুমকির গোপন তথ্য তার প্রতিষ্ঠান প্রার্থী এবং রাজনীতিকদের আগেও জানিয়েছে, ভবিষ্যতেও জানাবে। নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো হুমকির তথ্য জনগণ এবং সংশ্লিষ্টদের জানাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা নজিরবিহীন। সিনেটে উভয় দলের নেতারা ইভানিনাকে আগেই সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিদেশি শক্তিকে এমন সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না যে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারে।

আর দুই মাসও বাকি নেই। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বড় ধরনের হুমকির কথা জানিয়েছে মার্কিন সাইবার কোম্পানি মাইক্রোসফ্ট। তারা জানান—রাশিয়া, ইরান এবং চীনের হ্যাকাররা ট্রাম্প এবং বাইডেন দুই জনের নির্বাচনি প্রচারই হ্যাক করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি মাইক্রোসফেটর ভাইস প্রেসিডেন্ট টম বার্ট টুইটার বার্তায় জানান—রাশিয়া, চীন এবং ইরানের হ্যাকাররা মার্কিন নির্বাচনের প্রচারের সাইটগুলো হ্যাক করার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, বাইডেন, ট্রাম্পসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অ্যাকাউন্টও হ্যাক করার চেষ্টা হচ্ছে। হ্যাক করা হচ্ছে তাদের পরামর্শদাতাদের ডেটাবেসও। টম বার্ট জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়েও রাশিয়ার জিআরইউ মিলিটারি ইনটেলিজেন্স ইউনিট ভোট প্রচারের বিভিন্ন সাইট হ্যাক করেছিল। ঐ ইউনিটের কোড নাম ছিল ‘ফ্যান্সি বিয়ার’। এ বছরেও ফ্যান্সি বিয়ার মাঠে নেমে পড়েছে। এছাড়াও ইরান এবং চীনের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের হ্যাকাররা কাজ করছেন। ট্রাম্পের সহকারীরা জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে যে বাইরের শক্তিরা ট্রাম্পকে হারানোর ষড়যন্ত্র করবে, তা তাদের জানা। কিন্তু এতকিছু করেও প্রেসিডেন্টকে হারানো যাবে না। জো বাইডেনের শিবির অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ট্রাম্প এবং বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণায় সাইবার হামলার অভিযোগ নাকচ করেছে রাশিয়া, চীন এবং ইরান। ইতিমধ্যে মস্কোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিল বলে জানতে পেরেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা।

 ইতিহাসের বাঁক বদল!

বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ কোনো নতুন খবর নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুই ব্লকে ভাগ হয়ে যায়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের এবং যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে। দুই পক্ষই বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। নিজেদের মতাদর্শকে সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এজন্য তারা চেয়েছে বিভিন্ন দেশে তাদের মতাদর্শের সরকার আনতে। উদ্দেশ্য সফল করতে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অপছন্দের সরকারকে সরিয়ে দিয়েছে।

কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডোভ লেভিন সম্প্রতি ইউএসএ টুডেকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তার গবেষণায় পাওয়া তথ্য দিয়ে জানান, ১৯৪৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ প্রায় ৮১টি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়ার কেজিবি হস্তক্ষেপ করেছে প্রায় ৩৬টি নির্বাচনে। রাশিয়া সবচেয়ে বেশি করেছে ইউরোপের দেশগুলোতে যাতে তাদের প্রভাব সেখানে বজায় থাকে। আর যুক্তরাষ্ট্র বেশি করেছে এশিয়ার দেশগুলোতে।

তবে ইরান, ভেনিজুয়েলার নামও আছে হস্তক্ষেপের তালিকায়। কিন্তু এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেই হস্তক্ষেপের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে এই বিতর্কটা খুবই জোরালো হয়ে উঠছে। আবার রাশিয়াও বিভিন্ন সময় অভিযোগ করে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।