শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ট্রাম্পের নতুন মধ্যপ্রাচ্য

লক্ষ্য ইরান, ক্ষতির মুখে সৌদি আরব!

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩৯

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, নতুন মধ্যপ্রাচ্যে ভোর হলো। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, করোনা মহামারির দিন শেষ হবে, কিন্তু এই চুক্তির জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তি থাকবে। এর মাধ্যমে শান্তির ভোর হলো। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইতিহাসের গতি পরিবর্তন হলো। এদের সবার মতো বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও মহাখুশি। যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে ইসরাইলের সঙ্গে দুই মুসলিম রাষ্ট্রের চুক্তি ঐতিহাসিক সত্যি, কিন্তু এই ইতিহাস কত দিন টিকে থাকবে এবং ইতিহাসের গতি পরিবর্তনে কারা জয়ী এবং কারা পরাজিত হবেন তা নিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশ্লেষকদের মতে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরবদের আবেগ যে কমেছে তা প্রমাণিত। কিন্তু যে ইরানকে মোকাবিলায় এসব চুক্তি করা হচ্ছে তা সত্যিই বাস্তবে রূপ পাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাবে। কারণ এসব চুক্তি মূলত সরকারের সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে নয়। আবার সৌদি আরবের গোপন সমর্থনেই এসব চুক্তি হচ্ছে বলে ধারণা।

চুক্তির বিরোধী সৌদি আরবও!

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী দশটি দেশ হচ্ছে যথাক্রমে—মিশর, তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব, ইসরাইল, আলজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, সিরিয়া এবং মরক্কো। শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব, ইরান এবং তুরস্ক। সৌদি আরব বলেছে, তারা ফিলিস্তিন সমস্যার প্রকৃত সমাধান চায়। তাদের দাবি, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে তার রাজধানী করতে হবে। এই চুক্তিতে শুধু নতুন করে ফিলিস্তিনের এলাকা দখল না করার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইসরাইল। বিবিসি আরবি সংবাদ বিভাগের সিনিয়র নিউজ এডিটর মোহামেদ এয়াহিয়া বলেন, ইসলামি বিশ্বে নেতৃত্ব ধরে রাখার বিবেচনায় সৌদি আরব নিজে হয়তো এখন ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সময় নিচ্ছে। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে সৌদিদের অনুমোদন ছাড়া আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে এই চুক্তি করত না।

 ইরান আতঙ্ক

সৌদি আরব এবং আরো কিছু উপসাগরীয় দেশের মধ্যে ইরান ভীতি এতটাই প্রবল যে ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে তারা তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছে। ইরান তাদের অভিন্ন শত্রু। প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে ২০০২ সালে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয় যে যতক্ষণ না ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ফিলিস্তিনি জমি ছেড়ে দিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আরব-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকটের চেয়ে এখন ইরানকে মোকাবিলা তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। যুক্তরাষ্ট্রের সান-ডিয়েগো ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ আহমেদ কুর বলেন, আরব দেশগুলোর মধ্যকার বর্তমান বিভক্তি ও বিরোধ সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। একটি প্রভাববলয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে রয়েছে আমিরাত; ইরান-ইরাক-সিরিয়া এক দিকে, আবার কাতার যোগ দিয়েছে তুরস্কের সঙ্গে। ড. কুর বলেন, এই বিভেদকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে ইসরাইল। লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে এক সময় ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আরব দেশগুলোর রাস্তায় যতটা আবেগ চোখে পড়ত, এখন ততটা নেই।

লাভ-ক্ষতির হিসাব

মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে কলামিস্ট ডেভিড ইগনেসিয়াস লিখেছেন, চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতও লাভবান হবে। তারা হয়তো ইউরোপের মতো মুক্ত সীমান্তে বাণিজ্য করতে চায়। আমিরাতের এক কর্মকর্তা তো বলেছেন, আদর্শ দূরে থাক। ভবিষ্যত্ তথা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বাণিজ্যিক অংশীদারকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৃতীয় জয়ী দেশ হবে চুক্তির বিরোধিতা করা তুরস্ক। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্যি। কারণ আলেপ্পো, মসুল, ত্রিপোলি, দোহা এবং মোগাদিসুতে এখন তুরস্কের আধিপত্য। আবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। অনেক আরব রাষ্ট্র কিন্তু এখন ইরানের চেয়ে তুরস্ককে বেশি ভয় পায়। তুরস্কের আধিপত্য বাড়ার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে সৌদি আরব। কারণ অতীতের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির কর্তৃত্ব অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি যেসব দেশে টাকা ও আদর্শ ছড়ানো হয়েছে সেইসব দেশেও (ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশ) সৌদি আরব দুর্ভোগে আছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কারণে ওয়াশিংটনেও সৌদি আরবের অবস্থান ভালো নয়। আবার ইরান ইতিমধ্যে মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানে তালেবানরা লাভবান হবে। তবে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন। তবে ট্রাম্প বিরোধীরা মনে করছেন, তার ভাবমূর্তি করোনা ও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ফলে যে জায়গায় নেমেছে, সেখান থেকে ওঠার আশা কম।

এল-দাহশান মনে করেন, এই সম্পর্ক কতটা অর্থপূর্ণ হবে তা শেষ পর্যন্ত সেসব দেশের জনগণের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে। ৪০ বছর আগে মিশর এবং ৩০ বছর আগে জর্ডানের সঙ্গে ইসরাইলের একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও এই দুই দেশের মানুষের সঙ্গে ইসরাইলের বা ইসরাইলি জনগণের সম্পর্ক হয়নি। তিনি আরো বলেন, ইউএই বা বাহরাইনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক তৈরি না হলে তা শুধু দুই দেশের মধ্যে দূতাবাস স্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকবে। এল-দাহশান মনে করেন, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে ফিলিস্তিনি সংকটের সমাধান এখনো গুরুত্বপূর্ণ।