বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিদ্ধান্তহীন ভোটাররাই ফ্যাক্টর, বাড়ছে উৎকণ্ঠা

আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা বাকি। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে দেশজুড়ে ততই বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে এই উৎকণ্ঠা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নয়। শেষ মুহূর্তের কোন নাটকীয়তা সামনে আসবে, যা দেখে সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন, উৎকণ্ঠা এ নিয়েই। এসব ভোটারের সিদ্ধান্তই বলে দেবে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও চার বছর হোয়াইট হাউজে থাকবেন, নাকি ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন নতুন বাসিন্দা হবেন।

এদিকে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছে, ট্রাম্প হেরে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য। বুধবার ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য হিসাবে পরিচিত অ্যারিজোনায় এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে তিনি যদি হেরে যান তাহলে ফল মেনে নেবেন না। ট্রাম্পের এই বক্তব্য থেকেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ ট্রাম্পের যারা সমর্থক তারা ট্রাম্পকে ভীষণভাবে পছন্দ করেন। জনমত জরিপে ট্রাম্প অ্যারিজোনায় এগিয়ে রয়েছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে গোটা দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত হলেও ফলাফলের সমতা ভাঙেন সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা। বিশেষ করে ফ্লোরিডা রাজ্যের সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা যেদিকে ঝোঁকেন, তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

বিভিন্ন জনমত জরিপ বলছে, ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে না থাকলেও এবার ব্যবধান কমিয়ে আনতে পেরেছেন বাইডেন। বিভিন্ন জনমত জরিপ বলছে, সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা ভোটের আগমুহূর্তে কাকে ভোট দেবেন সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে এই রাজ্যের সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা ট্রাম্পকে অপছন্দ করেন, এমনটাই আভাস দিয়েছেন তারা। 

অন্যদিকে ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য হিসাবে পরিচিত ১৪টি রাজ্যে এখনো সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বাইডেন। তবে ৪৮ ঘণ্টায় এই ব্যবধান অনেকখানি বদলে যেতে পারে। ইতিমধ্যে টেক্সাস, অ্যারিজোনা ও ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প এগিয়ে রয়েছেন। বাকী ১১টি ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও সময় যত কমছে, দু’জনের ব্যবধান ততই কমছে। ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোর মধ্যে টেক্সাসে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ৩৮টি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই রাজ্যে জিতেছিলেন ট্রাম্প। 

আগামী ৪৮ ঘণ্টায় রিপাবলিকানরা জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তার ছেলে হান্টার বাইডেনের কথিত দুর্নীতির প্রসঙ্গ ছাড়াও নতুন আর কোন ইস্যু সামনে আনবেন তা নিয়ে ডেমোক্রেট শিবিরে উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। ইতিমধ্যে বাইডেনের পরিবারের অর্থের উৎস নিয়ে নানান কথা বলে বেড়াচ্ছেন ট্রাম্প। অথচ ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতায় করোনাভাইরাস মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রে সোয়া দুই লাখ লোকের মৃত্যুর ঘটনাটি বড় ইস্যু করে সামনে আনতে পারেনি ডেমোক্রেটরা। বরং ৭৪ বছর বয়সে ট্রাম্প করোনায় অসুস্থ হয়ে তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আমেরিকানদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, করোনাভাইরাস একটা সাধারণ ভাইরাস মাত্র। 

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে অর্থাৎ ১লা নভেম্বরের মধ্যে করোনাভাইরাসে দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে এই বিপুল মৃত্যুর ঘটনা ট্রাম্পের নির্বাচনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপে ৫৫ ভাগ আমেরিকান ট্রাম্প প্রশাসনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এখন সেই সমর্থন কিছুটা কমলেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং করোনা মহামারীর মধ্যেও ট্রাম্পের সমর্থকেরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন। 

ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হলে ইমিগ্রান্টদের ওপর কঠিন খড়গ নেমে আসতে পারে। গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন ট্রাম্প। অবৈধদের প্রবেশে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি ভিসা ব্যবস্থায় কঠিন শর্ত আরোপ করেছেন। ইমিগ্র্যান্টরা তাদের নিকট স্বজনদের জন্য ভিসা আবেদন করতে পারছেন না। কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সব আরোপ করছেন ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে আসলে ইমিগ্র্যান্টদের জন্য আমেরিকায় বসবাস কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্পের এই কড়াকড়ি আরোপে খুশী রিপাবলিকানরা। এমনকি সাধারণ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরাও এতে খুশী। অন্যদিকে ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব তার জনপ্রিয়তাকে কমাতে পারেনি। ফলে ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিকে উৎকণ্ঠায় থাকুক না কেন ট্রাম্প এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছেন।

২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তা আর বেশিদূর এগোয়নি। ট্রাম্প বেশ ভালভাবেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে কারচুপির অভিযোগ না থাকলে এবারের নির্বাচনে একমাত্র ট্রাম্পই আগাম কারচুপির আশঙ্কা করছেন। ফলে নির্বাচনে হেরে গেলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ছাড়বেন কী না তা নিয়েও উদ্বেগ রয়ে গেছে সবমহলে। হেরে যাবার পর কারচুপির অভিযোগ এনে ট্রাম্প আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারপতির তিনজনই ট্রাম্পের নিয়োগ করা। অন্যদিকে নয় বিচারপতির ছয়জনই রিপাবলিকান। ফলে অজানা কিছু আশঙ্কা থেইে যাচ্ছে। বুধবার অ্যারিজোনার সমাবেশে সরাসরি কারচুপির আশঙ্কা করেছেন।

তিনি বলেছেন, এবারের নির্বাচনে কারচুপি হবে। ট্রাম্পের সমর্থকেরা মনে করেন, ট্রাম্প হেরে যাওয়া মানেই নির্বাচনে কারচুপি হওয়া। প্রায় ৯ কোটি ভোটার ইতিমধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। ট্রাম্প শিবির মনে করছেন, অধিকাংশ আগাম ভোটই ট্রাম্পের বিপক্ষে গেছে। ফলে নির্বাচনে তারা পরাজিত হচ্ছেন। আর এ কারণেই ট্রাম্প আগেভাগে কারচুপির অভিযোগ করে রাখছেন। 

এদিকে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কা বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত নিউইয়র্কসহ বড় শহরগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম সতর্কতা নিতে শুরু করেছে। নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টার মেসিজ তাদের ম্যানহাটনের স্টোরের বাইরের গ্লাস শক্ত কাঠের আবরণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। 

রয়টার্স গত ৯ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচনের পর দাঙ্গা হতে পারে। ৭ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, নির্বাচনী কর্মকর্তারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আশঙ্কা করে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এফবিআই ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষ এড়াতে বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে। 

অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) বলছে, সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও অস্থিতিশীলতা রোধে বিভিন্ন রাজ্য ও কাউন্টি পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এপি আরো বলছে, আমেরিকানরা অস্ত্র সঙ্গে রাখেন। ফলে ভোটের দিন নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষ হলে অস্ত্রের ব্যবহার বাড়তে পারে।  এপি ও এনআরসির যৌথ এক জরিপে বলা হয়েছে, প্রতি ১০ জন ভোটারের ৭জন নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। 

টাইম ম্যাগাজিন গত ২৩ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে বলেছে, নিউইয়র্ক সিটির ১২০০ ভোটকেন্দ্রে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হবে। মিশিগানের গভর্নর ঘোষণা করেছেন, ভোটের দিন কেন্দ্রের আশেপাশে কেউ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে পারবে না। ইন্ডিয়ানা ও ফ্লোরিডা নির্বাচনে দিন ইমার্জেন্সি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করবে। টেক্সাসের ফিনিক্স পুলিশ বিভাগ নির্বাচনের আগে ও পরে সব ছুটি বাতিল করেছে।

ইত্তেফাক/বিএএফ