বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু সাইমন ড্রিং

আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১৭:১৪

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্ধু সাইমন ড্রিং চলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে সাইমন ড্রিংয়ের নাম। গত শুক্রবার তলপেটে সার্জারি চলাকালে তিনি লন্ডনে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

Simon Dring and Akku Chowdhury recollect the horrific days of 1971.

দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার ছিলেন সাইমন ড্রিং। বাংলাদেশের খারাপ পরিস্থিতি যখন চলছিলো তখন তিনি সাংবাদিকতা করছিলেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে।‌ হঠাৎ একদিন লন্ডনের হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন করে তাকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’

সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। কিন্তু পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিলো না। তারপরেও তিনি মার্চের ৬ তারিখ কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এসে পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা কাভার করেন। সেই ঐতিহাসিক দিনে তিনি ফুটেজও নিয়েছিলেন। এরপর সপ্তাহখানেকের জন্য সাইমন ড্রিং ঢাকা এসে আর ফিরে যেতে পারলেন না তিনি। 

পাকিস্তানের রাজনীতি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম সম্পর্কে তার জানাশোনার পরিধি বাড়লো। সে সময় বেশ কিছু বই পড়লেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার সঙ্গে তার পরিচয় হলো। এমনকি সম্পর্ক গড়ে উঠলো অনেকের সঙে। রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতেন লন্ডনে।

২৫শে মার্চ রাতে সাইমন ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পাকিস্তানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ২৭শে মার্চ "ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান" শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন বিখ্যাত ডেইলি টেলিগ্রাফে। যা প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ। যে রিপোর্ট সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। বিশেষ করে সে রিপোর্টের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশাল এক জনমত সৃষ্টি হয় পৃথিবীজুড়ে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় দু’শো বিদেশি সাংবাদিককে আটকে ফেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।

Simon Dring: A True Friend Of Bangladesh

সকল সাংবাদিককে হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে গণহত্যার কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারে বিশ্ব গণমাধ্যম। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। পাকিস্তানী সামরিক আইন অমান্য করে সাইমন ড্রিং লুকিয়ে পড়েন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তার শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘন্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেন প্রভৃতি স্থানে। পরে তিনি ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন গণহত্যার বাস্তব চিত্র। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সাইমন ড্রিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি প্রভৃতি স্থান প্রত্যক্ষভাবে ঘুরে দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। এমনকি তার ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়।

কিন্তু এতো নির্যাতনের পরেও তিনি দমে যাননি। বরং শক্ত হয়ে রিপোর্ট করেই গেছেন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের। এমন একজন মানুষ এই সাইমন ড্রিং যিনি কেবল সাংবাদিকতার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দাতব্য তহবিল দ্য রেস এসেইন্ট টাইম তার হাতেই গড়া। যেখানে ১৬০টি দেশের সাড়ে ৫ কোটিরও বেশী লোক স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়েছেন। আরেকটি ছিলো  "স্পোর্ট এইড" নামের আরকটি তহবিল। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ এ তহবিলে দান করেছিলো। যা ব্যয় করা হয়েছিলো আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য।

বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন স্টেশন একুশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর সময় সাইমন ড্রিংয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, তার হাত ধরে এ দেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এজন্য তাকে বলা হয় বাংলাদেশে ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার জনক। ১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে তিনি একুশে'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারী টেলিভিশনের আধুনিকতার অন্যতম রূপকার।

২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন সরকারের কথিত কর্তৃপক্ষ সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনজনিত কারণে তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ও তার সহযোগী তিনজন নির্বাহী পরিচালক প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে বলতে গেলে যা ছিলো পুরোপুরি  ভুয়া! এরপর ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন  বিএনপি সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দেয়। ফলে তিনি ১ অক্টোবর, ২০০২ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

ইত্তেফাক/এনএসএন