বুথ ফেরত জরিপগুলো আবারো ভারতে বিজেপির ক্ষমতায় আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু এই জরিপকে আমলে নিচ্ছে না কংগ্রেসসহ বিরোধীদলগুলো। বরং তাদের আশঙ্কা এই জরিপের আড়ালে ইভিএমে কারচুপির অপচেষ্টা হচ্ছে।
এই আশঙ্কা থেকে গতকাল মঙ্গলবার ভারতের নির্বাচন কমিশনে কিছু দাবি জানিয়েছে কংগ্রেসসহ ভারতের ২২টি বিরোধী দল। তাদের দাবি রাতারাতি ইভিএম বদলে দেওয়া হচ্ছে। ত্রুটিমুক্ত ভোট গণনার জন্য ইভিএমের আগে ভিভিপ্যাটের (ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রায়াল) স্লিপ গণনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিরোধীরা ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এ প্রস্তাবকে অর্থহীন বলে মন্তব্য করেছে। এদিকে বিরোধীরা জোট গঠনের তত্পরতা অব্যাহত রেখেছে। তাদের ধারণা, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অন্তত ৫০টি আসন কম পাবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। ফলে আঞ্চলিক দলগুলো জোট সরকার গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
গতকাল নির্বাচন কমিশনে দেওয়া পত্রে স্বাক্ষর করেন জাতীয় কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ, আহমেদ প্যাটেল, অশোক গেহলট, অভিষের মনু সিংভি, কে রাজু, রাজ বব্বর, অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু, উত্তর প্রদেশের সমাজবাদি পার্টির নেতা রাম গোপাল যাদব, সিপিআই (এম)-এর সীতারাম ইয়েচুরি, টি কে রঙ্গরাজন, আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এনসিপির প্রফুল প্যাটেল ও মজিদ মেমন, তামিলনাডুর ডিএমকে-র নেত্রী কানিমোঝি, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ও ব্রায়েন, বিএসপি নেতা সতীশ চন্দ্র মিশ্র, বিহারের আরজেডির মনোজ ঝা, সিপিআইর সুধাকর রেড্ডি, ডি রাজা, এলজেডির জাভেদ রাজওয়া প্রমুখ।
গুলাম নবী আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন পাঁচটি বাছাইকৃত ভিভিপ্যাটের স্লিপ আগে গণনা করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোট গণনার ভিভিপ্যাটের স্লিপ গণনা হবে। আমরা বলেছি, আগে ভিভিপ্যাটের স্লিপ গণনা করা হোক। ভিভিপ্যাটের কাগজের স্লিপের সঙ্গে ইভিএম তথ্যে কোনো গরমিল পাওয়া গেলে সেই আসনের সমস্ত ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএমের তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে। একইসঙ্গে তাদের দাবি, যে পাঁচটি বুথের ক্ষেত্রে ভিভিপ্যাটের স্লিপ এবং ইভিএম মিলিয়ে দেখার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন, সেই পাঁচটি বুথ গণনার আগেই বাছাই করে ফেলতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী শেষ রাউন্ডের ভোটের পরই এই পাঁচটি বুথকে লটারির ভিত্তিতে চিহ্নিত করার কথা।
গুলাম নবি আজাদ আরো বলেন, কংগ্রেস বা অন্য কাউকে ভোট দিলেও সেই ভোট বিজেপির খাতায় জমা হচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা আটকাতেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। এদিকে ইভিএম কারচুপির অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একইসঙ্গে কোথাও কোনো গাফিলতি থাকলে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হবে বলে বিরোধী দলগুলোকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আরো বলেছে, কোনো দল যখন হেরে যায় তখন তারা ইভিএমকে দোষারোপ করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শঙ্কর প্রসাদ বিরোধীদের এই দৌঁড়ঝাপের নিন্দা করে নির্বাচনে পরাজয়কে মেনে নেওয়া পরামর্শ দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে এই ইভিএম কারচুপির সপক্ষে বিরোধীরা বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কিছু স্ট্রং রুম (যেখানে ভোটের পর ইভিএম রাখা হয়েছে) থেকে বেসরকারি গাড়ি বা লরিতে করে ইভিএম বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে, গণনাকেন্দ্রে গাড়িতে করে ঢুকছে ইভিএম। অথচ, সেই গাড়িতে কোনো সরকারি সিল বা স্ট্যাম্প নেই। এরপরই বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি রাতারাতি হাজার হাজার ইভিএম বদলে দেওয়া চেষ্টা করছে। তাই তারা গণনা কেন্দ্রের বাইরে পাহারা বসিয়েছে।
বিরোধী দলগুলো বলছে, জরিপ প্রকাশ করে ইভিএমে বড় আকারে কারচুপির পরিকল্পনা করে রেখেছে বিজেপি।
উত্তরপ্রদেশে মোদির আসন বারানসির ঠিক পাশের আসন চান্দৌলিতে একটি গাড়িতে করে গণনাকেন্দ্রে ইভিএম রাখার ভিডিও ফুটেজ সামনে আসায় উত্তেজনা চরমে উঠেছে। ইভিএম কারচুপির অভিযোগ তুলে উত্তর প্রদেশের গাজিপুরে অবস্থান ধর্মঘটে বসেছেন ওই কেন্দ্রের জোটপ্রার্থী এবং বহুজন সমাজ পার্টির নেতা আফজল আনসারি। একের পর এক ঘটনা সামনে আসার পরই উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টির নেতা নরেশ উত্তম প্যাটেল দলীয় কর্মী সমর্থকদের রাজ্যের সকল স্ট্রং রুমে কড়া নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় কর্মী সমর্থকদের একই নির্দেশ পাঠিয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি এবং জাতীয় কংগ্রেস। এই সব ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গেও সতর্ক মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস।
ভিভিপ্যাট স্লিপ কি??
ইভিএমের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে ভিভিপ্যাট। কোনো ভোটার ভোট দেওয়ার পর তা ঠিক জায়গায় পড়ল কিনা, তা দেখিয়ে দেয় এই যন্ত্র। ভোট দেওয়ার পর ভিভিপ্যাট থেকে একটি স্লিপ বেরিয়ে আসে। সেখানে দেখা যায় কোন দলের প্রার্থীকে ভোটার ভোট দিয়েছেন। তারপর স্লিপটি যন্ত্রের ভেতরে ঢুকে যায় এবং সংরক্ষিত থাকে। অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ওই স্লিপ গণনা করে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপের ভোটের তথ্য ঠিকঠাক মিলছে কিনা।
বিরোধীদের জোট গঠনের
তত্পরতা অব্যাহত
এখনই হাল ছাড়তে রাজি নয় বিরোধীরা। তারা বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে ৫০টির মতো আসন কম পাবে বিজেপি জোট। ফলে আঞ্চলিক দলগুলো নিয়ে জোট সরকার গঠন সম্ভব হতে পারে। এ কারণেই তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডুর নেতৃত্বে বিভিন্ন দলের মধ্যে বৈঠক চলমান রয়েছে। এই জোট গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল নির্বাচন কমিশনে যান ২২টি দলের নেতারা। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিরোধীদের ঐক্য ধরে রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দলটি আগেই জানিয়ে রেখেছে বিরোধীদের ঐক্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে ছাড় দিতেও রাজি রয়েছে তারা।
ইত্তেফাক/নূহু