শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

তেল ট্যাংকারে হামলা রূপ নিতে পারে যুদ্ধে

আপডেট : ১৫ জুন ২০১৯, ০৮:২৯

হরমুজ প্রণালীর কাছে তেলের ট্যাংকারে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে ছয়টি ট্যাংকারে চোরাগোপ্তা হামলায় ইরানকে অভিযুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা। তবে ইরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দেশটির দাবি, এ ধরনের হামলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ককে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হচ্ছে। এ ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে মেরুকরণের নতুন মাত্রা দিয়েছে। পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতির প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করে বলছেন, এ উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা ছয় জাতি চুক্তি থেকে গত বছর ট্রাম্প প্রশাসন বেরিয়ে আসার পর সম্পর্ক দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে এনেছে ট্রাম্প সরকার। কোনো দেশ যেন ইরান থেকে তেল কিনতে না পারে, সেজন্যও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরান হুমকি দিয়ে আসছে যে, তেল রপ্তানি বন্ধ হলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ৩০ শতাংশই এ রুট দিয়ে পরিবহন হয়। গুরুত্বপূর্ণ এ রুট বন্ধ হলে বিশ্ব তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। ইরানের এ ধরনের পদক্ষেপ ঠেকাতে এবং হরমুজ প্রণালীকে উন্মুক্ত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সব ব্যবস্থা নেবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

বৃহস্পতিবার হরমুজ প্রণালীর কাছে ওমান উপসাগরে দুটি তেলবাহী ট্যাংকারে হামলা হয়। ট্যাংকার দুটির একটি নরওয়ের মালিকানাধীন ফ্রন্ট অলটেয়ার এবং অপরটি জাপানের মালিকানাধীন কোকুকা কারেজিয়াস। ইরান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুটি ট্যাংকার থেকে তারা ৪৪ জনকে উদ্ধার করেছে। মাত্র মাস খানেকের ব্যবধানে নতুন করে তেল ট্যাংকারে হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিশ্বে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবারই বিশ্বে তেলের দাম চার শতাংশ বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় ইরানকে শুরু থেকেই দায়ী করে আসছে। হামলার একদিন পরই যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, তাদের কাছে এমন একটি ভিডিও ফুটেজ আছে, যা প্রমাণ করে এটা ইরানের কাজ। তারা আরো দাবি করছে, এ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ইরানের রেভ্যুলশনারি গার্ড ক্ষতিগ্রস্ত একটি তেলের ট্যাংকারের একপাশ থেকে একটি অবিস্ফোরিত মাইন বা বোমা সরিয়ে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য অনুযায়ী ঐ অঞ্চলে মোতায়েন তাদের নৌবহরের কাছে দুটি বিপদ সংকেত বা এসওএস বার্তা আসে দুটি তেলের ট্যাংকার থেকে। দুটি ট্যাংকারেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল এবং আগুন ধরে গিয়েছিল।

ঘটনার পর পর সেখানে ইরানের নৌ টহল বোটগুলোর তত্পরতা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এর মধ্যে একটি টহল বোট ক্ষতিগ্রস্ত একটি তেলের ট্যাংকারের পাশে গিয়ে অবিস্ফোরিত একটি মাইন সরিয়ে ফেলে। দুটি ট্যাংকারের নাবিকদেরই উদ্ধার করে কাছাকাছি থাকা অন্য জাহাজগুলো। এদিকে, ইরানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, উপসাগরে তেলের ট্যাংকারে ইরানই হামলা চালিয়েছে। আমরা এ বিষয়টিকে হালকাভাবে নিচ্ছি না। ফক্স এন্ড ফ্রেন্ডস অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রমাণ রয়েছে। এ ধরনের হামলা কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটি আমরা দেখছি। তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ কি হবে সে ব্যাপারে কিছু বলেননি ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার জন্য সরাসরি ইরানকে দায়ী করেন।

তবে গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ টুইট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিন্দুমাত্র প্রমাণ ছাড়াই এ অভিযোগ তুলছে। তারা কূটনীতিকে বানচাল করতে ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ তত্পরতা চালাচ্ছে।

বিবিসির নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলেছেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র তাদের দাবির পক্ষে যে প্রমাণ হাজির করেছে, সেটা হয়তো আগেরবারের চেয়ে জোরালো। এর আগের হামলার সময় তারা কিছু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা ভিডিওতে যে টহল নৌযান দেখা যাচ্ছে, ইরানের বিপ্লবী বাহিনী সে ধরনের নৌযানই ব্যবহার করে। ইরান সাম্প্রতিক সময়ে উপসাগরীয় এলাকায় তাদের নৌবাহিনীর জায়গায় বিপ্লবী বাহিনীকেই বেশি মোতায়েন করছে। এই বাহিনীর ছোট-বড় বহু ধরনের নৌকা এবং জাহাজ আছে যেগুলো দ্রুত চলাচল করতে পারে। মাইন, মিসাইল এবং টর্পেডোবাহী এসব ছোট নৌযান শনাক্ত করাও কঠিন। বিপ্লবী বাহিনী ওই এলাকায় নিয়মিত মহড়া দেয়। গোপনে তত্পরতা চালায়। তবে বৃহস্পতিবার দুই ট্যাংকারে হামলার জন্য ইরান দাবি করছে অন্য কোনো পক্ষকে, যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষতি করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা ভিডিওটি আসল, নাকি নকল, তা নিয়ে তেহরানের সংশয় আছে।

মাত্র এক মাস আগে একই রকমের এক বিস্ফোরণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ওমান উপসাগরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো চারটি তেলের ট্যাংকার। সেবারও হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা।
এদিকে তেলের ট্যাংকারে হামলা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে উত্তেজনা আরো বাড়িয়েছে।

গতকাল নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হামলা সম্ভাব্য সামরিক যুদ্ধের আতঙ্ক তৈরি করেছে। হামলার পর বৃহস্পতিবারই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ ব্যাপারে পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোনাথান কোহেন বলেন, এটা এই অঞ্চলে ইরানের সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার আরেকটি উদাহরণ। তবে ইরানি স্থায়ী মিশন এই দাবি নাকচ করে বলেছে, এই সন্দেহজনক ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, নতুন করে তেল ট্যাঙ্কারে হামলা সামরিক উত্তেজনা বাড়াবে। ইইউ বলছে, তারা এখনই কোন মন্তব্য করবে না। এ ব্যাপারে আরো তথ্য সংগ্রহ করছে।

এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সিএনএন’র এক খবরে বলা হয়েছে, ইউএসএস বেইনব্রিজ কিংবা এর মিশনের ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা হলে তা মেনে নেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ, পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান ও বাড়তি সেনা মোতায়েন করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।

 ইত্তেফাক/এসআর