আবুল কাসেম ভূঁইয়া
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের খ্যাতি দেশব্যাপী রয়েছে। বর্তমানে এই মেজবান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা বেশ ঘটা করে এই মেজবানের আয়োজন করে থাকেন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান আদিকাল থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে। এই ঐতিহ্যবাহী মেজবান সম্পর্কে জানা যায়, ১৮ দশকের দিকে চট্টগ্রামে মেজবানের প্রচলন শুরু হয়। অতীতে চট্টগ্রামের ধনী লোকেরা বিভিন্ন উত্সব উপলক্ষ্যে গরিব লোকদের উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করতেন। সেই থেকে মেজবানের প্রচলন চলে আসছে। মেজবান শব্দটি একটি ফারসি শব্দ। এই মেজবানকে মেজ্জানি বলা হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য জেলায় এই মেজবানকে জেয়াফত বলা হয়। মেজবান সাধারণত কারো মৃত্যুবার্ষিকী, কুলখানি, চল্লিশা, ওরশ শরিফ, মিলাদ মাহফিল, নতুন বাচ্চার আকিকা, গায়ে হলুদ, নতুন ঘরে ওঠা অথবা নতুন ব্যবসায়-বাণিজ্য শুরু করার আগে মেজবানের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানে যেসব খাবারদাবার পরিবেশন করা হয়, সেগুলো অসাধারণ সুস্বাদু হয়ে থাকে। এই মজাদার খাবারের প্রতি সবার বেশ আকর্ষণ থাকে। মেজবানের খাবারের সঙ্গে অন্যন্য খাবারের তুলনা চলে না। মেজবানে সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে, রান্না করা গরুর মাংস, চনার ডাল, গরুর নলা, মাষকলাই ডাল, গরুর কালোভুনা তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব মজাদার খাবারের প্রতি ধনী-গরিব সবার বেশ লোভ থাকে। কোনো মেজবান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রতিটি মেজবানে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, গয়াল, উট জবাই করা হয়। হাজার হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করার জন্য অসংখ্য গরু, মহিষ জবাই করা হয়। বেশ উত্সবমুখর পরিবেশে মেজবানি খানা রান্না করা হয়। শত শত মানুষ মেজবানি খাবার রান্না করা এবং আয়োজনের ব্যাপারে সম্পৃক্ত থাকে। একসঙ্গে অসংখ্য মানুষ এখানে খাবার গ্রহণ করে থাকে। মেজবানের অপূর্ব এই দৃশ্য না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে চট্টগ্রাম সমিতি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের আয়োজন করে থাকে। দেশের সর্ববৃহত্ এই অনুষ্ঠানে ঢাকার সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম এই মেজবানের প্রচলন শুরু করেন, যা এখনো পর্যন্ত ঐতিহ্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেজবানি রান্নার জন্য চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত বাবুর্চি রয়েছেন। এদের মধ্যে আবুল বাবুর্চি হচ্ছেন সেরা। আবুল বাবুর্চি দেশের বাইরে গিয়েও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি রান্না করে থাকেন। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান বাবুর্চিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় মেজবানি রান্নার আলাদা স্বাদ হওয়ার মূল রহস্য। তারা জানান, মেজবানি রান্নায় তারা বিশেষ ধরনের মসল্লা ব্যবহার করে থাকেন। যার কারণে রান্না বিশেষ ধরনের সুস্বাদু হয়ে থাকে। মেজবানি রান্নার সুনাম এখনো পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের দেখাদেখি দেশের অন্যান্য জেলায় মেজবানি রান্নার আয়োজন করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মেজবানি খাবারের আলাদা আকর্ষণ থাকায় চট্টগ্রামের প্রতিটি খাবার হোটেলে মেজবানি খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। প্যাকেজ রেটে জনপ্রতি হিসেবে মেজবানি খাবার পরিবেশন করা হয়। যাদের মেজবানি খেতে ইচ্ছে করে তারা হোটেল রেস্টুরেন্টে গিয়ে মেজবানি খাবারের স্বাদ নিতে পারছেন। চট্টগ্রামে সারা বছর ধরে মেজবানি অনুষ্ঠান চলে। বিশেষ করে, শীতের মৌসুমে মেজবানি অনুষ্ঠান বেশি হয়ে থাকে। শীতের সময় বিভিন্ন মাজারে উরশ শরিফ, মিলাদ মাহফিল, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশি হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে মেজবানি খাবার পরিবেশন করা হয়। মেজবানে অনেক সময় মাছ, মাষকলাইয়ের ডালও পরিবেশন করা হয়। অতীতকালে গ্রামের মধ্যে অনুষ্ঠিত মেজবানি অনুষ্ঠান সারা দিনব্যাপী চলত। মেজবানের আগে ঢোল পিটিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে গ্রামবাসীদের মেজবানের দাওয়াত দেওয়া হতো। মেজবানের মাধ্যমে গ্রামের সব মানুষ একত্রে সমবেত হতো। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মেজবান নিয়ে বিদেশি একটি টিভি চ্যানেল প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করে নিয়ে গেছে। এই প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ আলোচিত হয়েছে। আমাদের অতীত ঐতিহ্যের ধারক-বাহক চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান এখনো পর্যন্ত তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে চলবে—এটাই প্রত্যাশা করি।
n লেখক :বিমা কর্মকর্তা