বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আন্দোলন

আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:৩১

কথায় কথায় হরহামেশাই বলি, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’ ছন্দের সঙ্গে নন্দের মন্দ ভাগ্যের কিচ্ছায় ঢের আনন্দ আমাদের। রোষ দেখিয়ে দোষ খুঁজিয়ে পথ দেখানোর হম্বিতম্বি করা শিক্ষানবিশ আইনজীবী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কি ভুল করে ভুলে গেছেন, নাকি নির্ভুলভাবে ভুলের ভান ধরছেন? আমাদের কর্মকাণ্ড ৭০ হাজার শিক্ষানবিশের কাছে আজ প্রশ্নবিদ্ধ! যত দোষ এই বার কাউন্সিলই নন্দ ঘোষ। প্রিলিতে রেজাল্ট খারাপ? হবেই তো। বার কাউন্সিল যদি আসমান থেকে প্রশ্ন নাজিল করে, তাহলে কেমনে সম্ভব? লিখিত পরীক্ষা কবে হবে? কাউন্সিল কর্তাব্যক্তিরা ঘুমালে কীভাবে হবে? লিখিত পরীক্ষার তারিখ নাকি ঘোষণা হয়েছে? করবেই তো। করোনার এই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় মানুষকে বিপদে ফেলা ছাড়া কাজ আছে? আমাদের দোষারোপের মাজেজার হকিকতের মুখোশ কিন্তু উন্মোচিত হয়েছে। গত ৭ জুলাই থেকে আমরণ অনশনে বসে মহানায়কের পরিচয় দিতে গিয়ে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। আন্দোলনকারীদের সব যুক্তিযুক্ততা মেনে নিয়ে বার কাউন্সিল আগামী ২৬ সেপ্টেম্বরে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই আমাদের মধ্যেই কিছু মুরব্বি আবার কেন যেন পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলন করছেন! পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য রিটের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন! তাহলে কি আমাদের মুরব্বিরা করোনার অজুহাতে পরীক্ষা ছাড়াই সনদ নেওয়ার কলকাঠি নাড়ছেন?

একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দোরগোড়ায় মানবসভ্যতা। সরকার সব অর্গানকে আধুনিকায়ন করতে চিন্তার টেবিলে মগ্ন। আর আমাদের শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধুগণ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বপ্ন দেখছেন—কীভাবে পরীক্ষা ছাড়াই সনদ নিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়! বিভিন্ন পেশায় অতিষ্ঠ হয়ে সুখের আশায় ভিড় জমানো স্বল্পমেয়াদি কিছু পাসকোর্স বন্ধুরাও এই একই কাতারে। ঘি যে দামে তেলও একই দামে। এই পদ্ধতিতে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার হবে কীভাবে? পাবলিক কিংবা প্রাইভেটের মেধাবী শিক্ষার্থীবৃন্দ তাহলে কোন যুক্তিতে এই মহান পেশায় আসতে চাইবেন? বিচারালয়ের পবিত্র আঙিনা ৭০ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর আলোয় আলোকিত হবে, নাকি কষ্টের করুণ পরিস্থিতি আবির্ভূত হবে—তা ভাববার সময় এসেছে।

করোনাকালের এই সংকটকালীন মহাদুর্যোগময় মুহূর্তে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের দুঃখদুর্দশার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নামা হলো। আন্দোলনের শুরু থেকে কিছু মানুষের নেতা হওয়ার মানসিকতায় টালমাটাল অবস্থা তৈরি হলেও বোধকরি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। বার কাউন্সিলের দায়িত্ববোধ থেকেই হোক আর আমাদের বেগবান আন্দোলনের জোড়েই হোক—লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছে। তাহলে আমরা সেই যে গত ৭ জুলাই থেকে আমরণ অনশনের নামে যে নাটকীয়তা শুরু করেছি সেটি অত্যন্ত লজ্জাকর আর হাসির খোড়াক বইকি। আমরণ অনশনের আজ প্রায় ৬০ দিন হতে চলেছে। কথায় কথায় প্রায়শই আমাদের বার কাউন্সিলের সঙ্গে ইন্ডিয়ার বার কাউন্সিলের মিল খুঁজি; কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির আইন কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশের কথা?

পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে রয়্যাল এই পেশার হালহকিকতের জন্য আসলে কে দায়ী? একবারও কি ভাববার মতো সময় হয়েছে? এমন পরিস্থিতির সুরাহা না খুঁজলে বিচারপ্রার্থী মক্কেলদের কুড়ে কুড়ে ছিঁড়ে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

ব্যঙের ছাতার মতো গিজ গিজ করে গজে ওঠা আইন কলেজের হিড়িক, সার্টিফিকেট ব্যবসাধারী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মতহীনভাবে আইন বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণের অনুমতিদান ভয়ংকর বিপজ্জনক। রাজধানীর এক কোচিংয়ে দেখলাম পঁচিশের কোটার ছেলেমেয়েও ক্লাসে আছে, আবার ৬৫ কোটার ডাঙ্গর তরুণ-তরুণীরাও আছে। মুরব্বিদের গল্প শুনতে গিয়ে মাথায় হাত! ক্যামনে এসব হয়! বুঝলাম আস্থার, মেধাবীদের প্রবেশের এই জায়গা নষ্ট হলে মাথা ঠুকরে অনুশোচনা করে শেষমেশ কোনো ফায়দা হবে না। এখনই লাগাম টানা দরকার।

সামগ্রিক পরিস্থিতির ইতিহাস বিবেচনায় আলোকিত পেশার গুণমানের দাফন সম্পন্ন করতে না চাইলে চিন্তার টেবিলে আসুন। বিচারাঙ্গনের অন্য ডানা বার কাউন্সিল ছাড়া বিচার বিভাগ অচল। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আন্দোলন নামে যে সার্কাস চলছে সেটি বন্ধের জন্য কাউন্সিলের অতিসত্বর পরীক্ষার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে নোটিশ প্রদান করে শিক্ষানবিশদের পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বার কাউন্সিলের ওএমআর শিট সংযোজন, রিভিউ করার সুযোগ, আগামী তিন মাসের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের ব্যাপারে কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তিদের মৌখিকভাবে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কাউন্সিলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দায় ঝেড়ে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।

n লেখক :সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী