কিছুদিন আগে আমার এক শিক্ষক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম, আমরা যেন সিনিয়রদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় নিজ থেকে হাত বাড়িয়ে না দেই করমর্দন করার জন্য। এটি নাকি বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ মানুষই অপছন্দ করেন। ভালো লেগেছিল। আমি জানি এটি অনেকেই মেনে চলেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা রয়েছে তাদের বেলায় এটি মানা হয় না অনেক সময়। তবে সম্পর্কের গভীরতা যতটাই থাকুক কিছু সময় কিছু ক্ষেত্রে আমাদের একটু দেখে-শুনে চলতে হয়। ভদ্রলোকেরা একে বলেন ‘ফরমালিটি’।
আমার প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম একজন রঞ্জিত পোদ্দার স্যার, ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এসে পেয়েছি। একদিন ক্লাসে তিনি বলেছিলেন, “আমি কখনোই আমার ছেলে-মেয়ের ক্লাস রোল নিয়ে ভাবি না, পরীক্ষার খাতায় কত পেল সেটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; আমি শুধু পর্যবেক্ষণ করি- তারা কি শিখছে, কতটুকু শিখলো, আরেকটু ভালো না শিখতে পারার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে”। আসলেই একটা ক্লাসের সবাই তো আর প্রথম স্থান অধিকার করতে পারবে না। কোনো ক্লাসে ৭০ জন শিক্ষার্থী থাকলে সেখানে ৭০টি পজিশন থাকবে। তবে প্রথম স্থান অর্জন করার সুযোগ সবার জন্যই আছে, চেষ্টা করা উচিত। প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও সবার আছে। হেরে যাওয়া মানে ব্যর্থ হওয়া নয়। পাশাপাশি অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
আমরা সকলেই এক প্রকৃতির অভিভাবক চিনি যারা নিজেদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা ও ভবিষ্যত্ নিয়ে খুব ভাবেন। এটি তারিফযোগ্য একটি বিষয়। তবে সন্তানের বয়স দুই বছর হতে না হতেই তাদের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়, কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন তাই নিয়ে। তিন-সাড়ে তিন হতে না হতেই শহরের নামি-দামি প্রি-স্কুল, কিন্ডারগার্টেন বা ইংলিশ মিডিয়ামে সাইনবোর্ড লাগানো প্রতারকতুল্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ভর্তির পর থেকেই টাকার খেলা সেখানে। ওইসব স্কুলের কর্তৃপক্ষ হলো এমন, শিক্ষার্থী সম্পর্কে যতটা সম্ভব ইতিবাচক মন্তব্য করে অভিভাবকদের মন ভুলিয়ে রাখে। নতুন অভিভাবকরাও এ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন, স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকে, তাদেরকেও বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করে খুশি রাখেন যার দরকার নেই। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় এইসব অভিভাবক যতটা ওইসব স্কুলের আভিজাত্য নিয়ে ভাবেন ততটাই উদাসীন হয়ে পড়েন সন্তানের ভবিষ্যত্ আভিজাত্য নিয়ে; তারা শান্তি অনুভব করেন এই ভেবে যে, আর যাই হোক স্কুলটা ভালো। ঠিক এমন ভালো স্কুলের খপ্পরে পড়ে অনেক বাবা-মাই হেরেছেন। কারণ, এরা বিদ্যালয়ের পেছনে টাকা খরচ করতে প্রস্তুত, ভালো কোচিংয়ের পেছনে টাকা ভাংতে প্রস্তুত, ভালো নোট গাইডও কিনে দেন কিন্তু সন্তান কি করছে, কি শিখছে, কোথায় যাচ্ছে, কি চাচ্ছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করতে রাজি নন। এদিকে আমাদের কিঞ্চিত খেয়াল রাখা জরুরি।
২০১৮ এর নিম্ন মাধ্যমিকের পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় না থাকার কারণে অনেক ছেলে-মেয়েই এপ্লাস পায়নি যা নিয়ে সন্তুষ্ট নন অনেক অভিভাবক। কিন্তু এরা এটা ভাবে না যে, এতে করে মেধাবীদের একটু হলেও সহজে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এখানে পরিমাপের চেয়ে মূল্যায়নই মুখ্য।
শেষের দিকে একটি কথা বলা খুবই জরুরি, তা হলো—‘আমার পরিবারের কাছ থেকে আমি যে শিক্ষাটি পেলাম সেটি সব সময়ই আমার কাছে পূজনীয়। কিন্তু আমি যা শিখলাম তা অনেক সময় অনেকের কাছেই আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে। ঠিক এ কারণেই আমাকে অনেক সময় আচার-ব্যবহারের পোশাক পরিবর্তন করতে হয়, পুরোনোটাও রেখে দেই। ওটা কাজে লাগে। কাজে লাগে নিজের মতো করে চলতে।
বাঁচো নিজের মতো করে, প্রয়োজনে নিজেকে বদলানো জরুরি, প্রয়োজন শেষে স্বরূপে ফেরো যদি তা ইতিবাচক বিবেচিত হয়।
n লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা