শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জীবিকার সন্ধানে বাড়ছে নগরমুখী মানুষের স্রোত

আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:২৬

জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই নগরমুখী হচ্ছে মানুষ। প্রতিনিয়ত শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হওয়ায় বিভাগীয় শহর বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রতি ঝুঁকছেন অধিকাংশ মানুষ। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সার্বিক সুবিধা বিবেচনায়ও রাজধানীতে প্রতিনিয়ত ভিড় বাড়ছে। এদিকে জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে এ সঙ্কট দূর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেশি বলে মনে করে মানুষ। দারিদ্রপীড়িত, নদীভাঙন, খরার মতো কারণেও সেখানকার মানুষ রাজধানীতে আসছে। কাজ ছাড়া শিক্ষার জন্যও মানুষ ঢাকায় আসে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সেবার জন্য তারা নগরমুখী হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) কীভাবে একটি শহরকে বসবাসযোগ্য করা যায় সেই নগর জীবনের কথা ভাবতে হবে। শহরের পরিকল্পনার পাশাপাশি গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের বিষয়টি বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

দিনাজপুর জেলার বাসিন্দা শাখওয়াত (৩৫)। তিনি লকডউনের পরই ঢাকা এসেছেন। গ্রামে তার দোকান ছিল। ব্যবসা মন্দায় আসায় তাকে শহরে পাড়ি জমাতে হয়েছে বলে জানান। এখন রিক্সা চালিয়ে তিনি হাজার ১২শ টাকা রোজগার করতে পারেন বলে জানান। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে এসেছেন আতোয়ার আলি (৪৫)। তিনি শহরে এসেছেন ৩ মাস আগে। শহরে তিনি ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন, বলেন, গ্রামে কোন কাজ নেই। রোজগারের কোন পথও নেই। একারণে শহরে আসা। এখনো কিছু কাজ করে রোজগার করতে পারছি, গ্রামে সেই সুযোগ নেই। শুধু শাখওয়াত কিংবা আতোয়ার নয়, এমন প্রতিদিন রাজধানীমুখী হচ্ছে হাজার হাজার অভাবী মানুষ।           

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় বর্তমানে ২ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে এক হাজার ৭০০। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, নগর গঠন কাঠামো লোক দেখানোতে আবদ্ধ না রেখে, শুধুমাত্র দর্শনীয় কাঠামো গড়ে না তুলে নিরাপদ, স্থিতিশীল কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। অর্থনীতির যে বেইজ ছিল কৃষি, সেখান থেকে ধীরে ধীরে আমরা শিল্পেও শিফট করছি। ফলে এক ধরনের নগরমুখিতা তৈরি হচ্ছে। ঢাকা শহর প্রায় ৩৫ শতাংশ জিডিপি কন্ট্রিবিউট করে। বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষ ১ শতাংশ জায়গার মধ্যে থাকে। এ বাস্তবতা একদিনে তৈরি হয়নি। নগরে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সকলের বসবাস নিরাপদ করার ব্যাপারে সঠিক আইনি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নগর নকশা পরিকল্পনা করার বিষয়ে প্রভাবশালী মহলের চাপকে উপেক্ষা করতে হবে। অন্যান্য জায়গায় দেখা যায়, একটা শহর থেকে আরেকটা শহরে স্থানান্তরিত হতে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় গ্রাম থেকে শহরে আসতে। কারণ এখানে সুযোগ-সুবিধা বেশি। এখানে কাজের জন্যে যারা আসেন, তার মূল কারণ হলো এখানে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেশি মনে করে মানুষ। এছাড়া দারিদ্রপীড়িত, নদীভাঙন ও খরার মতো কারণেও সেখানকার মানুষ রাজধানীতে আসছে। কাজ ছাড়া শিক্ষার জন্যও মানুষ ঢাকায় আসে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সেবার জন্য মানুষ নগরমুখী হয়। কিন্তু উন্নয়ন যদি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে অনেকটা সমাধান মিলতে পারে বলে মনে করেন। দেশের বেশিরভাগ গার্মেন্টস শহরে, নগর বা ঢাকার মধ্যে। এই গার্মেন্টস বা শিল্প কারখানাগুলোকে শহরের বাইরে বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলে হয়তো সেদিকেই লোকজন থেকে যেতো। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এককেন্দ্রিক একটি দেশ তৈরি করেছি। এবং সেটি আমরা ধারাবাহিকভাবে চলমানও রেখেছি। এক কেন্দ্র বলতে বাংলাদেশের সব ধরনের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক বা অন্য যেকোনো ধরনের বিষয় হোক না কেন তার একমাত্র কেন্দ্র হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। ফলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে জীবন-জীবিকা, আয়-রোজগার, সংস্থান বিষয়ে অনেক সুযোগ বেড়ে গেছে। যে কারণে মানুষ ঢাকায় আসে। যদি আমরা দেশটিকে বহুকেন্দ্রিক করতে পারতাম তাহলে কিন্তু মানুষ ঢাকা কেন্দ্রমুখী হতো না। এজন্য আমাদের যেটি দরকার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং শিল্পভিত্তিক অনেকগুলো কেন্দ্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের জন্য নগর পরিকল্পনার অন্যতম একটি ধাপ এটি হওয়া উচিত যে আমরা এককেন্দ্রিক বাংলাদেশের বদলে বহুকেন্দ্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলব। যদি বহুকেন্দ্রিক দেশ গড়ে তুলতে পারি তাহলে অনেকগুলো নগর হবে, সেই নগরের পরিকল্পনা এবং সেই নগরের মানুষের স্বাস্থ্যের পরিকল্পনা সহজেই এবং প্রয়োগযোগ্যভাবে করতে পারব।

তিনি বলেন, ঢাকা শহর যে সংখ্যক মানুষের জন্য তৈরি হয়েছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ এ শহরে বাস করে। বেশি মানুষ বসবাস করায় কারণে বসবাস অযোগ্য নগরের তালিকায় ঢাকা অনেক বছর ধরে প্রথমদিকে রয়েছে। সেজন্য ঢাকাকেন্দ্রিক নগর ব্যবস্থা থেকে সরে গিয়ে বহুকেন্দ্রিক, যদি ৬৪টি জেলায় ৬৪টি নগরী মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকাংশ সংস্থান হয়ে যায়, তাহলে মানুষ ঢাকামুখী হবে না এতে দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষা পাবে।

 

 

ইত্তেফাক/এমএএম