শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গারা

আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ০১:৪৪

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা একদিকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে ক্যাম্পেই নিজেরাই তৈরি করছে নানা ধরনের অস্ত্র। একইসঙ্গে সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকও আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। 

দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার একটি অংশের এটাই বড় ব্যবসা। তাদের এমন কাণ্ডে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির। ক্যাম্পের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে অস্ত্র হাতে মহড়া চালাচ্ছে নিয়মিত। দিন দিন অপরাধে জড়ানো রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে তৈরি করছে আগ্নেয়াস্ত্র। 

গতকাল সোমবার ও গত বছরের ৫ অক্টোবর অস্ত্রের পৃথক দুটি কারখানা আবিষ্কার করেছে র‌্যাব-১৫। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে কারখানা দুটির সন্ধান, অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় অস্ত্র তৈরির ৫ কারিগরও গ্রেফতার হন। 

ছবি: সংগৃহীত

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোহিঙ্গারা এদেশের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে। রোহিঙ্গারা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখনই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সারাক্ষণ গোয়েন্দা নজরদারি ও সঠিক মনিটরিং রাখতে হবে। নইলে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এদিকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্প মনিটরিং করছে। 

তারা আরও বলেন, রোহিঙ্গারা যেভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করছে, মাদক আনছে তা আমাদের জন্য বিপদজনক। তাই সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করে রোহিঙ্গাদের ২৪ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের আওতায় রাখতেই হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর ৪৫ থেকে ৫০ হাজার বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। জন্মের পর ছয় মাস অতিবাহিত হলেই তারা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো রেশন পেয়ে থাকে। এতে বাচ্চা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই সময় রোহিঙ্গাদের সন্তানরা বলবে, কক্সবাজার আমাদের জন্মস্থান। তখন কক্সবাজারের বাসিন্দারা হবেন সংখ্যালঘু। রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি আর আমাদের সংস্কৃতি মেলে না। এটা সাংঘর্ষিক। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু আছে, ওই সব দেশে সঠিক নীতিমালা মেনে চলে উদ্বাস্তুদের পরিচালনা করা হয়। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে সন্তান জন্মদানের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই সন্তানের বেশি হলে রেশন দেওয়া হবে না-এমন নিয়ম চালু করতে হবে।   

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

মিয়ানমারে নৃশংস নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লাখো রোহিঙ্গা। ক্ষত-বিক্ষত ও বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাকে স্থানীয়দের বদান্যতায় মানবিক সহায়তা দেয় বাংলাদেশ সরকার। উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্প স্থাপন করে বিশ্বসহায়তায় যোগানো হচ্ছে আহার। সেই সহায়তার ৪ বছরের মাথায় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি উপহার দিচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। 

ক্যাম্পের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে অস্ত্র হাতে মহড়া চালাচ্ছে নিয়মিত। এখানে দলগত সশস্ত্র তৎপরতা, মাদক-মানবপাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে তুচ্ছ ঘটনায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ক্যাম্পে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা বিস্তারে দেশীয় নানা অস্ত্রসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে একশ্রেণির রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। 

দিন দিন অপরাধে জড়ানো রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে তৈরি করছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব ছাড়াও রোহিঙ্গা আসার পর ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় (২০১৯ থেকে ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত) প্রায় ২ শতাধিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। এসময় গোলাবারুদ পাওয়া গেছে ছয় শতাধিক। আর গত অক্টোবর এবং চলতি মাসের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পে কর্মরত এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পসহ পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪৮টি দেশি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। 

এ সময় ৮২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে গোলাবারুদ, মামলা হয়েছে ৫৮টি। অপরদিকে, ২০১৯ সালসহ চলতি বছরের ১০ মাসে অস্ত্র মামলা হয়েছে ৭০টি। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৭টি দেশি পিস্তল, ৫৫টি এলজি, ৪টি বিদেশি পিস্তল, ৪০টি একনলা বন্দুক, ৩০টি দেশি বন্দুক, ৭টি পাইপগানসহ বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। 

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পই হবে অপরাধ তৈরির ক্ষেত্র।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা অস্ত্র পাচ্ছে, ক্যাম্পে অস্ত্র তৈরিও করছে। অপরাধ কেন্দ্র হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। দেশের অপরাধী চক্রের সাথেও রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ বেড়েছে। এটা আমাদের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই এখনই রোগীদের সব ধরনের নজরদারির আওতায় আনতে হবে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে হবে। নইলে সামনে আমাদের জন্য বড় ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলাজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা মেলে না। এটা সাংঘর্ষিক। মাদক ও অস্ত্র আনছে রোহিঙ্গারা। নিজেরা অস্ত্র বানাচ্ছে। একইসঙ্গে জঙ্গিদের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে সরকার। কিন্তু তারা সেটা দেখছে না। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানে তারা জড়িয়ে পড়েছে। 

কক্সবাজারে তারা যেভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করছে, এই প্রতিবছর যেভাবে সন্তান জন্ম দিচ্ছে, তাতে এক সময় কক্সবাজারবাসীরাই হয়ে যাবে সংখ্যালঘু। তাই এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। রোহিঙ্গাদের মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে সঠিক নীতিমালার আলোকে তাদের পরিচালনা করতে হবে। নইলে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রোহিঙ্গাদের সন্তানদের বয়স ৬ মাস হলেই বড়দের মতো রেশনিং দেওয়া হয় তাদেরও। এক্ষেত্রেও সঠিক নীতিমালা করতে হবে।

ইত্তেফাক/এএএম