বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সহিংসতা বাড়ছে ইউপি নির্বাচনে  

আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ০৫:২২

চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা থামছেই না। সহিংসতায় রূপ নিয়েছে ইউপি নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের বৈঠকে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে সহিংসতার আশঙ্কার পরও প্রাণহানি কমেনি। বরং একের পর এক সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিল ভারি হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর দুইবিভাগেই ৭জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এখন পর্যন্ত ইউপি ভোটে ৩০জনের প্রাণহানি ও চার শতাধিক আহত হয়েছে। হতাহতদের বেশিরভাগই তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। সর্বশেষ সোমবার মেহেরপুরের গাংনীতে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত মারা গেছেন। এ ঘটনায় দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি ১২জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও বিব্রত স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। তিনি বলেছেন, প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ইউপি ভোট বাতিল ও নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হবে।

ছবি: সংগৃহীত

ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে অন্য দলের কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত ক্ষমতাসীনরাই। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেকায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। স্থানীয়ভাবে দুই পক্ষই শক্তিশালী হওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উভয়পক্ষের সাথে সখ্যতা থাকার কারণেও সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়নে আগামী ১১ নভেম্বর এবং তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ১টি ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলায়-জেলায় অস্ত্রের ঝনঝনানিও বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সহিংসতা ততই বাড়ছে। ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। প্রভাব-জবরদোস্তির কারণে প্রায় দুই শতাধিক ইউপিতে ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীতরা।

নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে মাঠে নেই বিএনপি। দল মনোনীত একক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন না পেয়ে অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনী মাঠ দখলে জড়াচ্ছেন সংঘাত-সহিংসতায়। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ৬জনের প্রাণহানি হয়। এরপর চলমান দ্বিতীয় ও তৃতীয়ধাপের এখন পর্যন্ত ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।

এই সহিংসতার কারণ জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শাহদাত হোসেন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে এসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। তবে এই সহিংসতার জন্য প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অসহনশীল মানসিকতায় অনেকাংশেই দায়ী। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং প্রার্থীর সমর্থকদের সহনশীল হতে হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংযত হলে সহিংসতা কমে আসবে। সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

ইউপি ভোটের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন গত বৃহস্পতিবার সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে। ওই বৈঠক থেকে আলোচনা সভায় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার তার বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে সহিংসতার আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। সেই আশংকায় সত্য হলো। সভা চলাকালীন নরসিংদীতে ৪ জনের প্রাণহানি ও ৩০ জন আহত হন। গত বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে সদর উপজেলার চরাঞ্চলের আলোকবালী ইউনিয়নের নেকজানপুর গ্রামে এই হামলার ঘটনা ঘটে।

গত শনিবার রূপগঞ্জে গুলি করে হত্যা করা হয় মুড়াপাড়ার মাছিমপুর এলাকার মৃত আব্দুল জলিল মোল্লার ছেলে আব্দুর রশিদ মোল্লাকে (৩৩)। ডান কানের নিচে শর্টগান ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ সোমবার পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষ মেম্বর প্রার্থী আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে তার কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে বর্তমান সদস্য আজমাইন হোসেনের মামাতো ভাই জাহারুল (৫৭) ও সাহাদুলকে (৫৫)। এতে সংঘর্ষ বেধে গেলে বর্তমান সদস্য আজমাইন হোসেনসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছে।

গ্রাফিক্স: ইত্তেফাক

আমাদের মেহেরপুর প্রতিনিধি ও গাংনী সংবাদদাতা জানান, সোমবার সকাল ৯টার দিকে গাংনী উপজেলার লক্ষিনারায়ণপুর ধলা গ্রামের মাঝপাড়ায় সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাহারুল ও সাহাদুল আপন দুই সহোদর। তারা মৃত সুলতান ফকিরের ছেলে।

এতে জাহারুলের স্ত্রী সেফালি খাতুন (৪৫), মেয়ে চম্পা খাতুন (১৮), সাহারুলের মেয়ে সুবর্ণা খাতুন, বর্তমান ইউপি সদস্য আজমাইন হোসেন টুটুলসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছে। আহতদের গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও কুষ্টিয়া মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।

আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ড লক্ষিনারায়ণপুর ধলা গ্রামে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান সদস্য আজমাইন হোসেন টুটুল (মোরগ) এবং সাবেক সদস্য ও উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান (ফুটবল)।

দুই সহোদরের মৃত্যুতে পুরো পরিবার পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। ঘটনায় অভিযুক্ত আতিয়ার রহমান গাংনী উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বর্তমান ইউপি সদস্য আজমাইন হোসেনের ভাই এনামুল হক নইলু হত্যা মামলারও প্রধান আসামি।

ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আতিয়ার সহ ১৫-১৬ জনের একটি দল দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে জাহারুল ও সাহাদুলের ওপর হামলা চালায়। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে বড় ধরণের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই জাহারুল ও সাহাদুল মারা যায়।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, বর্তমান ইউপি সদস্য আজমাইন হোসেন টুটুলের জনপ্রিয়তা বেশি। এছাড়া আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। যে দ্বন্দ্বের জেরে এনামুল হক নইলুকে ২০১৭ সালে আতিয়ারের লোকজন কুপিয়ে হত্যা করে। যার প্রধান আসামি আতিয়ার রহমান। এর আগেও ২০০৯ সালে আজমাইনের ভাই সেন্টুকেও আতিয়ারের লোকজন হত্যা করে।

নিহত সাহাদুলের মেয়ে সুবর্ণা খাতুন জানান, বর্তমান মেম্বার আজমাইন হোসেন টুটুলের লোকজন সকালে ভোট চাইতে গেলে আতিয়ার রহমানের লোকজন অতর্কিত হামলা করে।

খবর পেয়ে মেহেরপুরের পুলিশ সুপার রাফিউল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) জামিরুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) অপু সরোয়ার, গাংনী থানার ওসি বজলুর রহমান, ডিবির ওসি জুলফিকার আলীসহ পুলিশের সকল ইউনিটের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পুলিশ গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ইউপি সদস্য প্রার্থী আতিয়ার রহমানের ভাই মহাব্বত হোসেনসহ ১২ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এছাড়াও পৃথকভাবে গাংনী র‍্যাব-৬ ক্যাম্পের এএসপি তারেক আনাম বান্নার নেতৃত্বে র‍্যাবের একটি দল সদস্য প্রার্থী আতিয়ার রহমানের ভাইয়ের বাড়ি থেকে সংঘর্ষে ব্যবহৃত ১১টি ধারালো অস্ত্র, ২টি টেটা, একটি বল্লম ও তিনটি মাথাল উদ্ধার করেছে।

নির্বাচন ভবন

গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রহমান জানান, লাশ দুটি ময়নাতদন্তের জন্য মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনা স্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১২ জনকে থানায় নেওয়া হয়েছে। কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরকে আটক দেখানো হবে।

মেহেরপুর পুলিশ সুপার রাফিউল আলম বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। তদন্ত সাপেক্ষে বিস্তারিত বলা যাবে।

স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল ইসি! ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণে নেই খাতা কলমে অগাধ ক্ষমতার অধিকারী কমিশনের। কেননা স্থানীয় প্রশাসন বরাবরই ইসিকে ‘সুষ্ঠু ও শান্তি পরিবেশ’ বজায় আছে বার্তা দিয়ে আশ্বস্ত করে রেখেছে।

ভোটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত বৃহস্পতিবার বৈঠক থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও মাঠ প্রশাসন তা মানছে না। প্রার্থিতা বাতিল ও ভোট বন্ধের নির্দেশনাও আমলে নেওয়া হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের কারোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে অন্য দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও অসহায়।

এককেন্দ্রীয় এই ভোট নিয়ে বিব্রত ইসি বলছেন, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।

ইত্তেফাক/এমএএম/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন